ঢাকা,  শনিবার  ২০ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

পুকুরে টাকা ডুবলেই ‘স্বপ্ন পূরণ’, পানির নিচে খাদেমের কারসাজি

প্রকাশিত: ০৯:০১, ১৬ মে ২০২২

পুকুরে টাকা ডুবলেই ‘স্বপ্ন পূরণ’, পানির নিচে খাদেমের কারসাজি

পুকুরের নামে মানত করে টাকা ফেলা হয়। আর সেই টাকা পানিতে ডুবে গেলেই ‘স্বপ্ন পূরণ’ হবে— এমন ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বিভিন্ন ধর্ম-পেশার মানুষ এসে টাকা ফেলছেন পুকুরে। তবে টাকা আটকে যাচ্ছে খাদেমের ফাঁদ পাতা জালে। দিনশেষে সন্ধ্যায় জমা হওয়া সব টাকা উঠানো হয়। এরপর তা শুকিয়ে করা হয় ব্যবহার উপযোগী। 
ঘটনাটি গাজীপুর কালিয়াকৈর উপজেলার জানের চালা গ্রামের একটি নোংরা পুকুরকে কেন্দ্র করে। যার নামকরণ করা হয়েছে ‘ষাঁড়ের পুকুর’। একশ্রেণীর মানুষের দাবি, ওই পুকুরে মানত করলেই ‘পূরণ হয়’ মনোবাসনা। এই ভরসায় দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ ওই নোংরা পুকুরের পানি পবিত্র মনে করে হাতমুখ পরিষ্কার করছে। অথচ সেখানে রয়েছে যথেষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি। একপর্যায়ে ওই পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিজেকে পরিষ্কার করার পর মানতের টাকা ভাসিয়ে দিচ্ছেন পুকুরে। 
রোববার (১৫ মে) সরেজমিন দেখা যায়, বিভিন্ন ধর্মের ও পেশার মানুষ সেখানে গিয়ে মানত করছেন। প্রথমে খাদেমের সংগ্রহ থেকে আগরবাতি, বাতাসা কিনে পুকুরের পাশে বটগাছের নিচে নিয়ত করে রাখছেন। এরপর ওই পুকুরে নেমে নোংরা পানি দিয়ে নিজেকে পরিষ্কার করেন। তারপর মানতকৃত টাকা পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। কেউবা পানিতে ফেলছেন গাভীর দুধ, কেউবা ফলমূল বা স্বর্ণের অলঙ্কার। তাদের ধারণা, যাদের মন স্বচ্ছ তাদের টাকা ডুবে যায়। আর টাকা ডুবে গেলেই মনের আশা পূরণ হবে। অথচ যাচাই করে দেখা যায়, সব টাকা-ই ডুবে যায় পুকুরে। 
স্থানীয়রা জানান, কয়েক শ’ বছর আগের পুকুর এটি। কথিত আছে, কোনো এক রাজা স্বপ্ন দেখেন; বাড়ির পাশের পুকুরে দুটি ষাঁড় দিতে হবে। পরে পুকুরে ষাঁড় দুটি নামিয়ে দেওয়ার পর এগুলো আর পাওয়া যায়নি। এরপর থেকেই পুকুরের নাম ষাঁড়ের পুকুর। তবে টাকা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রচলন খুব বেশি পুরাতন নয়। আগে মানুষ এসে মানত করে চলে যেতেন। কিন্তু পুকুরটি লিজ নেওয়ার প্রচলন শুরুর পর থেকে টাকা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রচলন জোরালো হয়েছে। 
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ছুটে আসেন এখানে। কেউ গরু, কেউবা ছাগল, হাঁসমুরগি মানত করেন। এরপর এখানে খিচুড়ি রান্না করে খায়। তারা অনেকেই দুধের সাথে টাকা ও স্বর্ণের গহনা ছেড়ে দেয় পুকুরে। তাদের ধারণা, টাকা ডুবে গেলে মনের আশা পূরণ হবে। তবে আমি বিশ্বাস করি না। আসলে এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। 
ওই পুকুরের খাদেম আমির আলী জানান, চলতি বছরে ৬ লাখ টাকা দিয়ে তিনি পুকুরটি ইজারা নিয়েছেন। এরপর মানত করার জন্য পুকুরের একটি নিদিষ্ট জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে। বরাদ্দকৃত জায়গাটি বাঁশ দিয়ে ঘেরাও করা। সেখানেই টাকা ফেলতে হয় সাধারণ মানুষকে। 
তিনি বলেন, যে অংশে মানুষ টাকা ফেলে; তার নিচে পাতা হয়েছে জাল। সারাদিন শেষে রাতে পুকুর থেকে জাল উঠিয়ে টাকা ও মানতকৃত সবকিছু নিয়ে নেন তিনি। তবে সব টাকা জালে আটকে যায় নাকি কিছু নষ্ট হয়— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কিছু টাকা ভেসে যায়। অনেকসময় পাওয়া যায় না।
উপজেলার বলিয়াদি গ্রাম থেকে মানত করতে এসেছেন অষ্টমী রানী। তিনি বলেন, যার মন স্বচ্ছ তার মনের আশা পূরণ হয়। পুকুরে দুধ ঢেলে দিলে ওই দুধ পানিতে না মিশে নিচে চলে যায়। এমনকি তার টাকাও ভেসে উঠেনি। তাই ভাবছেন, তার মনের আশা পূরণ হবে। তবে এর আগেও তিনি টাকা ভাসিয়েছেন কিন্তু মনোবাসনা পূর্ণ না হওয়ায় আবার এসেছেন।
এলাকার সচেতন মহল বলছেন, এই বিজ্ঞানের যুগে এসেও মানুষের মধ্যে এমন কুসংস্কার সত্যি কষ্টদায়ক। তারমধ্যে একশ্রেণীর মানুষ তাদের সহযোগিতা করছেন। পুকুরে টাকা ফেলায় আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। তাই বিষয়টি প্রশাসনের বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।  
কালিয়াকৈর পৌরসভার সচিব নওশিন আরা পুকুর নিজ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ওই পুকুর পৌরসভা লিজ দিয়েছে। এটি নতুন কিছু নয়। পৌরসভা গঠনের পর থেকেই লিজ দেওয়া হয়ে থাকে। 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ বলেন, জাল পেতে টাকা নেওয়ার বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম। বিষয়টি দুঃখজনক। পৌরসভার সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলে দেখি কোন প্রক্রিয়ায় লিজ দেওয়া হয়েছে। তারপর খোঁজখবর নিয়ে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেবো।

গাজীপুর কথা