ঢাকা,  মঙ্গলবার  ১৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

কালীগঞ্জে চায়না মুরগির খামার করে লাভবান এক দম্পতি

প্রকাশিত: ১৩:৪৭, ১ জুলাই ২০২১

কালীগঞ্জে চায়না মুরগির খামার করে লাভবান এক দম্পতি

ফিরোজ আলম লিংকন। গ্রামের বাড়ি গাইবান্দা জেলার সদর উপজেলার পলাশপাড়া গ্রামে। ওই গ্রামেরই মো. মকবুল হোসেন ও শেফালি সরকার দম্পতির প্রথম সন্তান তিনি। তিন ভাই, দুই বোন। তার অন্য ভাই-বোনেরা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় জড়িত। তবে ফিরোজ পেশায় একজন এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসায়ী। মূলত চায়নার সঙ্গে তিনি ব্যবসা করেন। সেখানে আসা-যাওয়ার সুবাদে পরিচয় হয় ওই দেশের নাগরিক স্কুল শিক্ষক ওয়াং লু ফিং সুফির সঙ্গে। একসময় তারা বিয়ে করেন। এরপর দুজনে মিলে বাংলাদেশে চলে আসেন।

কর্মচঞ্চল সুফি বেকার বসে থাকতে রাজি নন। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের নগরভেলা গ্রামে কিছু জমি ভাড়া নিয়ে প্রথম শখের বশে সেখানে এস এস রেয়ার ব্রিজ অ্যান্ড এগ্রো ফার্ম শুরু করেন।  চায়না থেকে ডিম এনে তা ইনকিউবেটরের মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় ৮৪টি মুরগি পান। সেখান থেকে এখন তাদের খামারে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি মুরগি। নগরভেলার মুরগির খামার ছাড়াও রাজধানীর উত্তরা এলাকার উত্তরখানে আরও তিনটি খামার গড়ে তুলেছেন। ওই খামারগুলোর একটিতে ডিম পাড়ানো হয়, একটিতে ইনকিউবেটরের মাধ্যমে ডিম ফোটানো হয় এবং অন্যটিতে বাংলাদেশি এবং চায়না মুরগির মধ্যে ক্রস করানোর প্রক্রিয়া করানো হয়। যাতে দুই দেশীয় মুরগির মাধ্যমে নতুন একটি জাত উদ্ভাবন করা যায়। এতে বাংলাদেশের মুরগির স্বাদটা ঠিক রেখে চায়না মুরগির গ্রোদটা রাখা যায়। তাতে কম সময়ে বেশি লাভবান হওয়া যাবে।

এস এস রেয়ার ব্রিজ অ্যান্ড এগ্রো ফার্ম রয়েছে চায়না মুরগির জাত শিল্কি, কাদানাদ, হুং ইয়াং চি, হো ইয়াংচি, চ কো ছাড়াও বিভিন্ন মুরগি। এরা চায়না থেকে মুরগি এনে বাংলাদেশের মুরগির সঙ্গে এক খামারে রেখে লালন-পালন করছেন।

ফিরোজ আলম লিংকন জানান, তিনি চায়নায় এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা করেন। চায়না থেকে এ দেশে মাল এনে বিভিন্ন জায়গায় পাইকারি বিক্রি করেন। তবে করোনা মহামারির কারণে পুরো বিশ্ব যখন স্থবির হয়ে পড়ে, তখন সব দেশের ফ্লাইড বন্ধ হওয়ার কারণে তাদের এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা স্থির গতিতে চলতে থাকে। এসময় তার স্ত্রী ওয়াং লু ফিং সুফি শখ করে কিছু মুরগির ডিম চায়না থেকে এদেশে নিয়ে আসেন এবং সেগুলো ইনকিউবেটরের মাধ্যমে ফুটানো হয়। পরে সেই চায়না মুরগীর বাচ্চাগুলো লালন-পালান করতে থাকেন। তবে জীবন্ত মুরগি আনতে গেলে অনেক নিয়ম-কানুন মানতে হয়। তাই বিমানবন্দরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সর মাধ্যমে ডিমই আনা হয়। পরে তা প্রক্রিয়াজাত করে ইনকিউবেটরের মাধ্যমে বাচ্চা ফোটানো হয়। তবে চায়না থেকে যে জাতটা নিয়ে আসা হয়েছে, সেটার গ্রোদটা বাংলাদেশের দেশি মুরগির চেয়ে খুব ভালো। খরচও কম। কারণ ঘাস, পাতা ও ফেলে দেওয়া খাবার খাইয়ে লালন-পালনের মাধ্যমে এগুলোকে বড় করা যায়। রোগ বালাই কম হওয়াতে এর ওষুধেল খরচও কম। সেই মুরগির বাচ্চাগুলো শখের বশে লালন-পালন করতে করতে মুরগির সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে, তখন তারা চিন্তা করেন বাণিজ্যিকভাবে কিছু যায় কিনা। 

শখ করে ৮৪টি চাইনিজ মুরগির ডিম ইনকিউবেটরের মাধ্যমে বাচ্ছা ফোটানোর পর এখানে এখন সাড়ে তিন সহাস্রাধীক মুরগি। তবে হো ইয়াংচি মুরগির গ্রোদটা খুব ভালো, অনেকটা পাকিস্তানি মুরগির মতো। হো ইয়াংচি নিয়মিত ডিম দিচ্ছে। সেই ডিম তাদের নিজস্ব ইনকিউবেটরে ফুটিয়ে বাচ্চা তৈরি করছে। যেখানে তারা বেশ ভালো সুফল পাচ্ছেন। মটালিটির দিত থেকে হো ইয়াংচি বাংলাদেশের মুরগির চেয়ে এক শতাংশেরও কম। তাই এটাকে আরও উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে যারা মুরগি পালন করতে আগ্রহী, যারা কৃষিকে ভালোবাসে বা কৃষি নির্ভির ব্যবসা করতে চান, সেই বেকার যুব সমাজকে কাজে লাগাতে চান তিনি।

ফিরোজ বলেন, বাংলাদেশের মুরগি ৪ মাসে ৮শ/৯শ গ্রাম হয়ে থাকে, আর চায়না মুরগি দুই মাসের মধ্যে আড়াই কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের যে পিওর দেশি মুরগির জাত, যেটা বাংলাদেশে বেশি দামে বিক্রি হয়, সেটা চায়না মুরগির সঙ্গে ক্রস করে দুটোর যদি একটি জাত বের করা যায়, তাহলে সেটার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাটা বাংলাদেশের মুরগির চেয়ে ভালো হবে। অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে বাংলাদেশি মুরগি লালন-পালন করতে গিয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। সেক্ষেত্রে দুটোর ক্রস যে জাত সৃষ্টি হবে, তা পালনে অনেকেই আগ্রহী হবেন। কারণ, এটা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকতে পারে।

ফিরোজ আলম বলেন, মুরগি পালনে ঠান্ডা জনিত সমস্যাটা একটু বেশি। তবে চায়না মুরগি রোগ-প্রতিরোধের ব্যাপারে বাংলাদেশি মুরগির চেয়ে অনেক কম। সাধারণত চায়না মুরগির ঠান্ডা জনিত রোগের কারণে মানুষের জন্য যে নাপা বরি বা নাপা সিরাপ অথবা এনামাইসিন বেট দিয়ে দু-তিন দিনের একটি কোর্স করালেই মুরগি স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে চাইনিজ মুরগিগুলো গরমের সময় ৪০/৪২ সেন্টিগ্রেট ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং শীতের সময় ১০ এর নিচে ঠান্ডা সহ্য করতে পারে। এজন্য এটার মটালিটিটা এত কম। শীতের সময় মুরগির খামারিদের ব্লোডিংয়ের একটা সমস্যা হয়ে থাকে। দেশি মুরগি, সোনালী ও লেয়ার ৫ মাস থেকে ডিম দেওয়া শুরু করলেও চায়না জাতের ১/২টি মুরগি বাংলাদেশে পরিবেশের কারণে একটু সময় বেশি লাগলেও বেশির ভাগ চায়না মুরগি ৪ মাস বয়স থেকে ডিম দেওয়া শুরু করে।
 
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে শুরু থেকেই ভালো চায়নিজ মুরগি এদেশে লালন-পালন সহজ ছিল না। আস্তে আস্তে এই দেশের পরিবেশের সাথে মিল রেখে রোগ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে লালন-পালনের উপযোগী করা হয়েছে। মুরগির ঠান্ডা বাড়ছে কেন? গরম লাগছে কেন? এ জিনিসগুলো একটু সময় নিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে কিছু কিছু ওষুধ চায়না থেকে আনা হয়েছে। যেগুলো বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। তবে চায়না থেকে ওই ওষুধগুলো স্বল্পমূল্যে আনা সম্ভব। যারা খামারি আছেন, চায়না মুরগির চাষ করেন, তাদের সাথে যোগাযোগ করেও ওষুধ চায়না থেকে নিয়ে আসা হয়। কেউ কেউ শখের বসে পালনের জন্য বা খাওয়ার জন্য কিছু কিছু কিনে নিচ্ছেন। তবে এটা নিয়ে বাণিজ্য করার ইচ্ছা নেই। দেশের বেকার যুবকদের কর্মমূখী করার জন্যই এই শখের খামার। চাইলে যে কেউ খামারে যোগাযোগ করে ওই জাতের মুরগি কিনে লালন-পালন করে কৃষি মুখী হয়ে নিজের বেকারত্ব দূর করতে পারেন।

ফিরোজ আলমের স্ত্রী ওয়াং লু ফিং সুফি জানান, তিনি আগে একজন শিক্ষক ছিলেন। আর যেহেতু তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, তাই চেষ্টা করছেন কৃষি বিষয়ের উপর নিজেকে আত্মনির্ভর করা যায় কিনা। তবে তার এ ইচ্ছাটা নিতান্তই শখ থেকেই তৈরি হয়েছে। যেহেতু তিনি এ লাইনে একেবারেই নতুন, তাই কোনো মুরগি অসুস্থ হলে বা কোনো মুরগি মারা গেলে সেই মুরগি তিনি নিজেই ময়নাতদন্ত করেন। পরে সেই বিষয়গুলো নিয়ে অনলাইনে সার্চ দেন। চায়নায় যে ওষুধটা দিলে এটা ভালো হয়, সেই ওষুধ সম্পৃক্ত কোনো গ্রুপ বাংলাদেশে আছে, তা দিয়েই তিনি ব্যবস্থা নেন। মোটামুটি সেই ওষুধ খাওয়ালেই মুরগি ভালো হয়ে যায়। যেহেতু এটা চাইনিজ মুরগি, চায়নার পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত, তাই চায়নার সাথে মিল রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হয়। চেষ্টা করা হচ্ছে বাংলাদেশের পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত করতে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে মুরগিটা আছে, সেটা খেতে খুবই সুস্বাদু। যদিও বাংলাদেশি মুরগি প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে বড় হয়, তবে এটার বড় সমস্যা বাংলাদেশি মুরগির গ্রোদটা কম। তবে চাইনিজ যে মুরগিটা আছে, সেটার সাথে যদি বাংলাদেশি মুরগির ক্রস করানো যায়; তবে দেশি মুরগির স্বাদটাও ঠিক থাকলো, পাশাপাশি গ্রোদটাও বাড়লো। সেক্ষেত্রে কম সময়ে লালন-পালন করে মুরগি খামারিরা লাভবান হবে বলে তিনি মনে করেন।

চাইনিজ দম্পতির বিভিন্ন জাতের মুরগির খামারের ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পাদ কর্মকর্তা ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, আমি ইতোমধ্যে খামারটি পরিদর্শন করেছি। এখানে চায়না শিল্কি জাতের যে মুরগিটা আছে, সেটা খুবই সম্ভাবনাময়। খুব কম সময়েল মধ্যো ডিম দেয় এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে বড় ও ওজন বৃদ্ধি হয়। যেহেতু একেবারেই চায়না ওই জাতের মুরগি পালন এদেশে নতুন, তাই রোগ-বালাইয়ের ব্যাপারে স্থানীয় প্রাণিসম্পাদ বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।

গাজীপুর কথা