ঢাকা,  বুধবার  ২৪ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

বাংলাদেশ কি বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কায়

প্রকাশিত: ১০:২৮, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাংলাদেশ কি বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কায়

ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকা।

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত মানুষের সংখ্যা ৭ হাজার ৮০০ ছাড়িয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, মৃতের সংখ্যা ২০ হাজারে গিয়ে ঠেকতে পারে।

গত সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) তুরস্কের স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে এ ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে। ভূপৃষ্ঠের ১৭.৭ কিলোমিটার গভীরে ছিল এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। সোমবার ভোরে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ১২ ঘণ্টা না পেরুতেই ৭.৬ মাত্রার আরেকটি এবং ১১ মিনিট পর ৭.৫ মাত্রার আরও একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এছাড়াও আরও অনেক ছোটো ছোটো ভূকম্পন হয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো স্থানে ভূকম্পনের জন্য ফল্টলাইনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূতত্ত্বের বিশাল খণ্ডকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফাটলকে ফল্ট বা চ্যুতি লাইন বলা হয়। ফল্টলাইন দিয়ে ২ প্লেটের সংঘর্ষ হলে ভূমিকম্প হয়।

তুর্কিতে যেখানে ভূমিকম্প হয়েছে, সেখানে রয়েছে পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট। তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম বরাবর এ ফল্টের অবস্থান। পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে বহু আগে থেকেই খুবই বিপজ্জনক উল্লেখ করে সতর্ক করে আসছিলেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। প্রায় ৫০০ বছর ধরে এ অঞ্চল বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কায় ছিল। তেমনি বাংলাদেশের মূল ভূভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় এ রকম কয়েকটি ফল্ট রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

এ বিষয়ে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক তাদের গবেষণায় জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমারের কিছু অংশে প্রচণ্ড শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলটির বিস্তার প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। এতে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

নেচার জিওসায়েন্স সাময়িকী প্রকাশিত ওই গাবেষণায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশসহ ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে একটি সুবিশাল চ্যুতির (ফল্ট) অবস্থানের কারণে এ এলাকায় রিখটার স্কেলে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এ রকম দুর্যোগে ঢাকাসহ বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বিপুল প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। ফল্ট এলাকার আশপাশের ১০০ কিলোমিটার এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ভূতত্ত্ব) ও ভূমিকম্প গবেষক আক্তারুল আহসান সময় সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ভূমিকম্প হবে কি না, এ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে, গবেষণা সেটাই বলে। আমরা যেসব ডাটা অ্যানালাইসিস করেছি তাতে জানা গেছে, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকেম্পর আশঙ্কা রয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্প হলে কত মাত্রার হবে, এটা নিয়ে কনট্রোভার্সি (বিতর্ক) রয়েছে। অনেকেই বলছে ৮ মাত্রার ওপরে যাবে, কেউ বলছে ৭ মাত্রার, আবার কেউ বলছে ৬ মাত্রার হবে। তবে বাংলাদেশের মাঝের পার্টটাতে যে পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে, তাতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। এখন কথা হচ্ছে, সেই পরিমাণ শক্তি একবারে নির্গত হবে কি না, সেটা নির্ভর করবে আমাদের উইক জোনের ওপর। যেমন: তুর্কি ও সিরিয়া সীমান্তে ৭.৮, ৭.৬ ও ৭.৫ মাত্রার তিনটি ভূমিকম্প হয়েছে। এছাড়াও ছোটো ছোটো আরও অনেক ভূকম্পন হয়েছে। তার মানে সেখানে যে শক্তি জমা ছিল, সেটা মোটামুটি বড় তিনটি ভূমিকম্পের মাধ্যমে রিলিজ হয়েছে। একবারে কিন্তু হয়নি, একবারে হলে এটা ৯ মাত্রার ওপরে যেত। বাংলাদেশে যেটা হতে পারে সেটা হচ্ছে ৫ মাত্রার অনেক ভূমিকম্পের মাধ্যমে সে এনার্জি রিলিজ করতে পারে। আবার ৭ বা ৮ মাত্রার ২ বা ৩টি কম্পন দিয়ে শক্তি নির্গত করতে পারে। তবে গবেষণা বলছে, ৮ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্পনের মতো শক্তি এ জোনে জমা হয়ে আছে।  

তবে এ গবেষণার বিষয়ে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী। তিনি জানিয়েছেন, ‘এ গবেষণায় যে ফাটলরেখা দেখানো হয়েছে, তার বাইরেও একটা ফাটলরেখা মিয়ানমারের সমান্তরালে চলে গেছে। সেখানে গত কয়েক শতাব্দীতে বড় ধরনের অনেক ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু এই গবেষণায় যে ফাটলরেখা দেখানো হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের প্রায় মাঝ বরাবর চলে গেছে। এই রেখার ওপর অতীতে কোনো বড় ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য মেলেনি।’ 

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে গ্লোবাল আর্থকোয়েক মডেল প্রকাশিত এক গবেষণার বরাত দিয়ে বুয়েটের এ অধ্যাপক আরও বলেন, বাংলাদেশের উত্তরে ভুটান এলাকায় ২৫ কিলোমিটার লম্বা একটি ফাটলরেখা আছে। সেখানে যেকোনো সময় ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।

নেচার জিওসায়েন্স-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জলমগ্ন এই নিম্নাঞ্চলে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এক হয়ে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ গঠন করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। এই যৌথ নদীপ্রবাহে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পলিমাটি জমে। নিরবচ্ছিন্ন এই পলিস্তূপের কারণে গাঙ্গেয় বদ্বীপের নিচের ভূপ্রকৃতি ব্যতিক্রমী ধরনের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, পললভূমির নিচে অবস্থিত টেকটোনিক প্লেটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে থাকে। 

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষক দল বাংলাদেশের অতিসংবেদনশীল বিভিন্ন এলাকায় বেশকিছু গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমসের (জিপিএস) যন্ত্র স্থাপন করে। দীর্ঘ ১২ বছর ওই গবেষণায়, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারেও এ রকম কিছু যন্ত্র বসিয়ে সমগ্র ফল্ট অঞ্চলের একটি মানচিত্র তৈরি করে। 

তাদের স্থাপিত জিপিএসের তথ্যানুযায়ী, একটি টেকটোনিক প্লেট আরেকটির নিচের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর সেগুলোর অবস্থান বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও পূর্ব ভারতজুড়ে বিস্তৃত একটি অঞ্চলের নিচে। ফল্টের ওপরের স্তরে দুটি প্লেট পরস্পর লেগে আছে। এতে সৃষ্ট চাপের প্রভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভূকম্পন হতে পারে। 

বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে ভূমিকম্প হতে পারে 

দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি ফল্ট রয়েছে। এসব অঞ্চলগুলো খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের এখানে ১৮৭০ থেকে শুরু করে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তুরস্কের মতো বা এর চেয়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। তুরস্কের ভূমিকম্পগুলোকে সে তুলনায় ছোটই বলা যায়। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ২০০-২৫০ বছর। ১৭৬২ সালে আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সাইকেল হিসেবে সেটি এখনও ফিরে আসেনি। এরপর ১৮৮৫ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা হয়ত আরও ১০-২০ বছর পর হতে পারে। এ রকম ২০০-২৫০ বছরের যে সাইকেল আছে, সেটি কখন হবে কেউ জানে না। ফলে তুরস্কও ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করতে পারেনি। আসলে ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করা সম্ভব না।  

এ বিষয়ে গবেষক আক্তারুল আহসান বলেন, বাংলাদেশকে আমরা জিওগ্রাফির ভাষায় ‘বেঙ্গল বেসিন’ বলে থাকি। এর মধ্যে পুরো বাংলাদেশসহ ভারতের কিছু অংশ এবং মিয়ানমারের কিছু অংশ রয়েছে। আমাদের নর্থ-ইস্টার্ন পার্ট বা ভারতের মেঘালয়ের সঙ্গে যেখানে আমাদের সীমানা, সেখানে ‘ডাউকি ফল্ট’ নামে একটা ফল্ট আছে। যেখানে ১৮৯৭ সালে মেঘালয় সীমান্তে ৮ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। সেটা আমরা সরেজমিনে গিয়েও তার প্রমাণ পেয়েছি। এ ছাড়া সিলেট-শ্রীমঙ্গল অঞ্চলে ১৯১৮ সালে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ব্রিটিশরা। ব্রিটিশদের বাংলো ও ক্লাবঘরগুলো ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। তা ছাড়া ১৮৮৫ মানিকগঞ্জের কাছে যমুনা নদীর কাছাকাছি ভূমিকম্প হয়। ওটা তখন মাপা হয়নি তবে, পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে ওটা ৭ এর ওপরে ভূমিকম্প ছিল। আনুমানিক ৭ দশমিক ৬ বা ৮ মাত্রার ছিল।  

তিনি বলেন, এসব থেকে বোঝা যায়- যেখানে একবার ভূমিকম্প হয় সেখানে আবার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটার টেকটনিক একটা কারণ রয়েছে। যেমন ধরেন- তুর্কিতে যে জায়গায় ভূমিকম্প হয়েছে, সেখানে বিগত ৫০০ বছরে ধরে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনায় ছিল। ইন্দোনেশিয়া, নেপালের আশপাশ অঞ্চলগুলো কিন্তু ভূমিকম্প হচ্ছে। হয়তো এ বছরে হচ্ছে না কিন্তু ৫০ বা ১০০ বছর পর হবে। সে হিসাবে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের নর্থ-ইস্টার্ন জোনে ‘ডাউকি ফল্ট’ রয়েছে, সিলেট-শ্রীমঙ্গল অঞ্চল এবং মানিকগঞ্জে আরেকটা ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া চিটাগং জোনেও ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। যেটা মিয়ানমার পর্যন্ত চলে গেছে। এই জায়গাটাতে শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ হচ্ছে যে অঞ্চলগুলোতে পাহাড় হয় সে অঞ্চলগুলো পাহাড় হয় একটা সংকোচন শক্তির জন্য বা একটা স্লাইডিং বা ফল্টের জন্য। তুর্কিতে যেটা হয়েছে। 

ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড কত বছর?

যেসব অঞ্চলে অতীতে ভূমিকম্প হয়েছে, সেসব অঞ্চলে ভবিষ্যতে আবারও ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ ওই অঞ্চলগুলো টেকটোনিক প্লেটের ফাটল থাকে, যাকে জিওগ্রাফির ভাষায় ‘ফল্ট’ বলা হয়। সাধারণত এসব ফল্টে একবার এনার্জি রিলিজ হলে শক্তি সঞ্চার হতে একটা দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ২০০-২৫০ বছর। ১৭৬২ সালে আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সাইকেল হিসেবে সেটি এখনও ফিরে আসেনি। এরপর ১৮৮৫ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা হয়তো আরও ১০-২০ বছর পর হতে পারে। এরকম ২০০-২৫০ বছরের যে সাইকেল আছে, সেটি কখন হবে কেউ জানে না। ফলে তুরস্কও ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করতে পারেনি। আসলে ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করা সম্ভব না। 

এ বিষয়ে আক্তারুল আহসান বলেন, শক্তি জমা হওয়ার সময়টাকে আমরা ‘রেকারেন্স প্রিরিয়ড’ বা রিটার্ন পিরিয়ড বলি। ১৮৯৭ সালে মেঘালয়ের যে ভূমিকম্পটা হয়েছিল সেটা শক্তি সঞ্চার হতে ২০০ বছর লাগবে। তবে অ্যাকুরেট (সঠিক) সময় বলা যাবে না। তবে বিভিন্ন গবেষণায় এই ‘রেকারেন্স প্রিরিয়ড’কে ২০০ থেকে ২৫০ বছর হিসেবে ধরা হয়। কোনো কোনো সময় তা আরও দীর্ঘ হতে পারে। যেমনটা হয়েছে তুরস্কের ক্ষেত্রে। ওই অঞ্চল ৫০০ বছর ধরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের শঙ্কায় ছিল।  

ছোটো ছোটো ভূমিকম্প কি বড় ভূমিকম্পের আভাস

ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের এই গবেষক বলছেন, ১৮৯৭ সালে মেঘালয়ে ঘটে যাওয়া ওই ভূমিকম্পের হিসেবে ইতোমধ্যে ২০০ বছর পার হয়ে গেছে। যেটা এখনও শক্তি রিলিজ করেনি, তার মানে ওখানকার শক্তি এখনও জমা আছে। তবে ওখানে কিন্তু মাঝে মাঝে ছোটোখাটো ভূমিকম্প হচ্ছে, তার মানে কিছু এনার্জি রিলিজ হচ্ছে। আর কিছু এনার্জি রিলিজ হওয়া মানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা কমে যাওয়া। একেবারেই যে কমবে তা না, যেটা ৮ দশমিক ৫ মাত্রার হতো সেটা হয়তো ৭ দশমিক ৫ মাত্রার হতে পারে। এমন না যে, সেটা একবারে ৫-৬ মাত্রায় নেমে আসবে। এটা ৭ মাত্রার ওপরে থাকার কথা। 

বাংলাদেশের আশপাশে কতটা ফল্ট রয়েছে? 

ভূমিকম্প গবেষক আক্তারুল আহসান বলছেন, এ বিষয়ে আমাদের দেশে তেমন কাজ হয়নি। কেউ কেউ বলেন ৫টি আবার কেউ বলেন ৭টি। তবে এ বিষয়ে কোনো সার্ভে হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে এ বিষয় নিয়ে আমি কাজ শুরু করেছি। তবে সমস্যা হচ্ছে এর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই। এ কাজও কম হয়। আমি কাজ করতে গিয়ে কিছু বিষয় পেয়েছি তবে, কনক্লুশনটা (উপসংহার) করা যাচ্ছে না। কারণ এটা পুরো দেশে সার্ভে করে এটা বলতে হবে, কয়টা ফল্ট রয়েছে। তবে চিহ্নিত হিসেবে মেঘালয় সীমান্তে, সিলেট-শ্রীমঙ্গল বা প্রতিটি পাহাড়ের আশাপাশে এ ধরনের ফল্ট রয়েছে।    

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের প্রভাব 

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। নিয়ম না মেনে যত্রতত্র নির্মাণ করা হয়েছে বড় বড় ভবন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে নানা সমস্যা ধরা পড়েছে। সেখানে বালু ভরাট করে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করতেও দেখা যায়। ভূমিকম্প হলে এ রকম ভবন সহজেই ধসে পড়বে। এ ছাড়া অতিরিক্ত জনবহুল হওয়ায় সেখানে ভূমিকম্প হলে প্রাথমিক উদ্ধার তৎপরতায় বিঘ্ন হতে পারে। এখন স্বাভাবিক অবস্থায়ই ঢাকা শহরে যানবাহন চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানকার রাস্তায় যদি ভূমিকম্পের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো এবং উদ্ধার তৎপরতা চালানো সত্যিই অসম্ভব কাজ হবে। তবে এই ভূমিকম্প ঠিক কখন হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটা আগামীকালই হতে পারে, আবার ৫০০ বছর পরেও হতে পারে। 

নেচার জিওসায়েন্সে প্রকাশিত ওই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত ভবন ছাড়াও ভূমিকম্পে ভারী শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হতে পারে। 

ভূমিকম্পে বাংলাদেশের প্রস্তুতি 

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের প্রস্তুতি নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আমাদের সক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা আছে। কারণ হিসেবে তারা রানা প্লাজাসহ বিভিন্ন সময়ে বড় ধরনের দুর্যোগের কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া যেসব সরঞ্জাম রয়েছে, সেগুলোও অব্যবহৃত অবস্থায় নষ্ট হচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়ে বলেছেন, আমাদের বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্টকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে ৯৯ শতাংশ নতুন ভবন টিকে যায়। তবে পুরনো ভবনের জন্য মজবুতিকরণ পন্থায় যেতে হবে। এ ছাড়া স্থানীয় কমিউনিটিকে ক্ষমতায়ন করার বিষয়েও তারা জোর দিয়েছেন তারা।  

বিষেজ্ঞরা বলছেন, তুরস্ক আমাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত। তারা ভূমিকম্প আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্গত এলাকায় তল্লাশি ও উদ্ধারকারী বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছে, হেলিকপ্টারে করে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। তুরস্কের সব ভবন তো আর ভালো নয়, যেগুলো ভেঙেছে সেগুলোর বেশিরভাগই ২-৩ তলার, তবে আশপাশে বহুতল ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আবার আমাদের শহরগুলোর গলি খুবই সরু। এ ক্ষেত্রে তুরস্ক ও সিরিয়ার রাস্তাঘাট কিন্তু এমন না, বেশ চওড়া এবং সহজেই যে কোনো জায়গায় পৌঁছানো যায়। পুরান ঢাকায় যদি ভূমিকম্প হয়, দেখা যাবে কোনো গাড়িই সেখানে ঢুকতে পারবে না। 

বছর কয়েক আগে এক জরিপে জানানো হয়, বাংলাদেশে ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার প্রায় ৭২ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা রাতের বেলা হলে নগরীর ৯০ হাজার মানুষ হতাহত হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে। 

গবেষক আক্তারুল আহসান বলেন, ভূমিকম্পের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে তেমন প্রস্তুতি নেই। যদি বড় রকমের ভূমিকম্প হয়, তাহলে যে সক্ষমতা রয়েছে তাতে সামাল দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগে প্রফেসর মোহাম্মদ শফি-উল্লাহ বলেন, ভূমিকম্প হলে সেটা সামাল দেয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের খুব একটা নেই। এই খাতে বিনিয়োগ করলে সেটার তাৎক্ষণিক ফল দেখা যায় না। তাই আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে যেটা হয়, তা হলো যখন যেটা দরকার সেখানে বিনিয়োগ করা হয়।