ঢাকা,  শুক্রবার  ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

শোকাবহ ১৫ আগস্ট ‘কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ’

প্রকাশিত: ১৯:০৭, ১৪ আগস্ট ২০২২

শোকাবহ ১৫ আগস্ট ‘কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

‘কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ, এ দয়া তোমার, মনে রবে চিরদিন’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেম ও প্রকৃতি থেকে উচ্চারিত লাইন দু’টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সূর্য অস্তমিত হলে তারপর জোনাকিরা জ¦লে, কিন্তু জোনাকিরা কখনোই সূর্যের বিকল্প হতে প্রারে না। যতই দিন যাচ্ছে এই সত্যটি ততই স্পষ্টতর হচ্ছে। বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরঞ্জীব, তার চেতনা অবিনশ্বর। মুজিব আদর্শে শানিত বাংলার আকাশ, বাতাস, জল, সমতল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনাশিত চেতনা ও আদর্শ প্রবহমান থাকবে।

আজ মানুষ উপলব্দি করতে পেরেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বাংলাদেশের নাম চিরতরে মুছে ফেলবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। কিন্তু তাদের সেই বিশ্বাসঘাতকতা, উচ্চ বিলাসী ধ্যান ধারণা বাস্তব রূপ লাভ করেনি। সেদিন কেঁদেছিল আকাশ, ফুপিয়েছিল বাতাস। বৃষ্টিতে নয়, ঝড়ে নয়, অনুভূতি ছিল পিতা হারানো শোকের। প্রকৃতি কেঁদেছিল কারণ মানুষ কাঁদতে পারেনি। ঘাতকের উদ্যত রক্তচক্ষু তাদের কাঁদতে দেয়নি। তবে ভয়াতুর বাংলার প্রতিটি ঘর থেকে এসেছিল চাপা দীর্ঘশ্বাস। কী নিষ্ঠুর, কি ভয়াল, ভয়ঙ্কর সেই রাত। আগামীকাল রক্তঝরা, অশ্রুভেজা ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। বাঙালি জাতির শোকের দিন।

১৫ আগস্ট বাংলার ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক একটি দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘাতকের বুলেটের নিষ্ঠুর আঘাতে নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন পরিবারের প্রায় সকল সদস্যসহ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে জুড়ে দেয় কৃষ্ণ দাগ। মানচিত্রের কাঁধে চাপিয়ে দেয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভারি বোঝা। বঙ্গবন্ধু ও তার স্বজনদের রক্তে সেদিন প্লাবিত হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের সেই ঐতিহাসিক বাড়ি। অস্তমিত হয়েছিল জাতীয় গৌরব এর প্রতীক সূর্যের মতো অনন্য এক অধ্যায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট লন্ডনের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে অন্ধ-বিদ্বেষপ্রসূত অভিযোগ সংবলিত একটি দুই কলামব্যাপী বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এই বিজ্ঞাপনে বঙ্গবন্ধু সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটরশিপ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী উক্তি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, অন্যদের সাথে মাওপন্থীরাই এর সঙ্গে জড়িত ছিল। কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, বজলুল হুদা, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী এবং রাশেদ চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মেজর ছিলেন।

বিদেশি গোয়েন্দাদের থেকে ইঙ্গিত পেয়ে তারা সরকারকে উৎখাত করে নিজেদের সামরিক সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলেন, ফারুক মেজর জিয়াউর রহমানকে ইঙ্গিতে এ পরিকল্পনায় অংশগ্রহণের প্রস্তাব করেন, কিন্তু জিয়া কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। ফারুকের মতে, জিয়ার ইঙ্গিতের অর্থ ছিল : ‘আমি দুঃখিত, আমি এ ধরনের কাজে নিজেকে জড়াতে চাই না, তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু একটা করতে চাও, তাহলে তোমাদের নিজেদেরই তা করা উচিত, আমাকে এসবের মধ্যে টেনো না।’

ঘাতক লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদের স্ত্রী ও আসামি জোবায়দা রশিদ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ‘সেনাবাহিনীর পাশাপাশি রক্ষীবাহিনী গঠন করে বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়াতেও আর্মির অফিসারদের মধ্যে সমালোচনা হয়। এসব বিষয় ফারুকের কাছে শুনি। মেজর ফারুক জেনারেল জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করত ছোটবেলা থেকেই। তিনি জিয়ার পূর্বপরিচিত ছিলেন। একদিন রাতে মেজর ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। জিয়া নাকি বলে, ‘ইট ইজ এ সাকসেস দেন কাম টু মি। ইফ ইট ইজ অ্যা ফেইলার দেন ডু নট ইনভলব মি। শেখ মুজিবকে জীবিত রেখে সরকার পরিবর্তন সম্ভব নয়।’

এর কয়েক দিন পর মেজর ফারুক আমার বাসায় এসে রশিদকে বলে যে, জিয়া বলেছে, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খুঁজতে হবে যে দায়িত্ব নিতে পারবে। সে মোতাবেক রশিদ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগামসি লেনের বাসায়। ১৫ আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে জেনারেল জিয়াউর রহমান রশিদের কাছে ঘোরাঘুরি করছিল যাতে তাকে চিফ অব আর্মি করা হয়। ১৬ অথবা ১৭ তারিখ প্রাক্তন মন্ত্রী সাইফুর রহমানের গুলশানের বাসায় সাইফুর রহমান, আমার স্বামী ও জিয়ার উপস্থিতিতে জিয়াকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করার বিষয় ঠিক হয়।’

মেজর জেনারেল (অব.) এম খলিলুর রহমান (তৎকালীন বিডিআরের পরিচালক) তার সাক্ষ্যে বলেন, ‘জেনারেল জিয়া নম্বরের ভিত্তিতে জেনারেল সফিউল্লাহর সিনিয়র থাকা সত্ত্বেও তাকে সেনাপ্রধান না করায় কিছু আর্মি অফিসার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। তখন এই সমস্যা দূর করার জন্য শুনিয়াছি, জেনারেল জিয়াকে আর্মি হতে অবসর দিয়ে অ্যাম্বাসেডর (রাষ্ট্রদূত) হিসেবে বিদেশে পাঠাই দেবে। মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানের পর একপর্যায়ে মেজর রশিদ তার স্ত্রীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন।

আমার মনে হলো, মেজর রশিদ একটু গর্ব করে বলেন, ‘ইনি আমার স্ত্রী। আমরা যা করেছি তার প্রধান প্ল্যানার আমার স্ত্রী।’ ঘাতক দল সম্ভাব্য ব্যর্থতার কারণগুলো কী হতে পারে তা বিবেচনা করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার পর তাদের অনুমান অনুযায়ী সম্ভাব্য ভারতীয় হস্তক্ষেপ, আওয়ামী লীগের প্রতিশোধমূলক সশস্ত্র বিরোধিতা ও আওয়ামী লীগ-বিরোধীদের বাড়তি স্বেচ্ছাচারী-বিশৃঙ্খলা দমন এবং সাময়িকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুজিবের দল আওয়ামী লীগ থেকে তাদের একজন শুভাকাক্সক্ষী এবং চাইলে সময়মতো সরিয়ে দেওয়া যাবে এমন ব্যক্তিকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। বেশ কিছুকাল অনুসন্ধানের পর মুজিবের মন্ত্রিপরিষদের আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণে সম্মত হন। তবে মোশতাক ও সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি চক্রান্তে জড়িত ছিল বলে সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ দাবি করেন।

দক্ষিণ এশিয়ায়, এমনকি সমগ্র বিশ্বেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিশ্বের ইতিহাসে আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, জন এফ কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং, ললুম্বা, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তারা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে বিশ্বের যেকোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিষ্কার পার্থক্য লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, যা বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল। বিশ্বরাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক নেতাকে এতটা নির্মমভাবে সপরিবারে পৃথিবী ত্যাগ করতে হয়নি।

বাংলাদেশর স্থপিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ মানুষের হৃদয়ের সম্রাট। অবিসংবাদিত এই নেতা বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত-নির্যাতিত জনতার মুক্তির ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি। অস্বীকার করার উপায় নেই, এই নেতা জন্মগ্রহণ না করলে হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশ মনের অভ্যন্তরেই লালিত স্বপ্ন হয়ে রয়ে যেত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে বাঙালি জাতি বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে অহর্নিশ যন্ত্রণার দহনে দগ্ধ হয়েছে। জাতি যখন একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তখন বিশ্ব এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর দেখতে পেয়েছিল।

আজ আমরা সবাই স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ রাজনীতিবিদ, কেউ আইনজীবী, কেউ চিকিৎসক আবার কেউ লেখক। এসব সম্ভব হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন বলিষ্ঠ নেতার শক্তিশালী নেতৃত্বের কারণে। কাজেই আমরা যে যেখানে আছি সে অবস্থান থেকেই বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করা উচিত। হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলেছেন, শেখ মুজিব দৈহিকভাবেই মহাকায় ছিলেন, সাধারণ বাঙালির চেয়ে অনেক উঁচুতে ছিল তার মাথাটি, সহজেই চোখে পড়ত তার উচ্চতা। একাত্তরে বাংলাদেশকে তিনিই আলোড়িত-বিস্ফোরিত করে চলেছিলেন, আর তার পাশে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছিল তার সমকালীন এবং প্রাক্তন সকল বঙ্গীয় রাজনীতিবিদ।

জনগণকে ভুল পথেও নিয়ে যাওয়া যায়; হিটলার-মুসোলিনির মতো একনায়করাও জনগণকে দাবানলে, প্লাবনে, আগ্নেয়গিরিতে পরিণত করেছিলেন, যার পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ। তারা জনগণকে উন্মাদ আর মগজহীন প্রাণীতে পরিণত করেছিলেন। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিলেন শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ আগ্নেয়গিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালি মুসলমানকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের হত্যাকাণ্ড শুধু বাঙালির ইতিহাসে নির্মম ট্র্যাজেডিই নয় বরং এ অভাগা জাতির জন্য ১৫ আগস্ট মর্মবিদারী ভয়াবহ শোকের দিন। আগস্ট মাস শোকের মাস। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে এ জাতি হারিয়েছে তাদের জনককে। যদিও শেখ রাসেলসহ অনেকেই রাজনীতির বাইরে ছিলেন, তবুও কেন তাদের হত্যা করা হয়েছিল সে প্রশ্নের জবাব আজও অমীমাংসিত।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সেনাবহিনীর মুষ্টিমেয় বিপথগামী উচ্চাভিলাষী সদস্য হত্যাকাণ্ড চালায়। হত্যার মাধ্যমে ঘাতকরা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল একটি নীলনকশা। তাদের পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তারা জাতির বিরত্বগাথা ইতিহাসকে অপ্রাসঙ্গিক করবে। বাঙালির ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, স্বাধিকার আন্দোলন সর্বোপরি লাখ লাখ শহীদের জীবনদান এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতা অর্থহীন করতে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। ১৫ আগস্ট প্রতিবছর আসে আমাদের হৃদয়ে শোক ও কষ্টের দীর্ঘশ্বাস হয়ে। শুধু আনুষ্ঠানিকতার বৃত্তে বন্দি না থেকে চিন্তামনন ও কর্মে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ ও তা বাস্তবায়ন করতে পারলে তার আরদ্ধ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

লেখক : আইনজীবী ও পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়