ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ২৫ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

গাছের শরীরে বইছে ড্রাগনের রক্ত!

প্রকাশিত: ২২:২৭, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২

গাছের শরীরে বইছে ড্রাগনের রক্ত!

গাছের যে প্রাণ আছে, তা ১৯০১ সালেই প্রমাণ করেছিলেন বাঙালি বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বোস। শুধিই প্রাণ নয়, রীতিমতো অনুভূতিও আছে। ব্যথা, আনন্দ এমনকি স্নেহও না কি অনুভব করতে পারে তারা। কিন্তু তাই বলে গাছের গায়ে রক্ত? ডালে আঘাত পড়লেই ঝরঝর করে ফেটে বেরোচ্ছে রক্তের ধারা। এও কি সম্ভব? অবিশ্বাস্য শোনালেও, এই পৃথিবীর বুকে আছে এমনই এক আশ্চর্য গাছ, যে নিজের শরীরে ধরে রেখেছে টকটকে লাল গাঢ় এক তরল। সে রক্তও আবার যেমন তেমন রক্ত নয়, প্রাগৈতিহাসিক এক হিংস্র ড্রাগনের শরীরের রক্ত।

ইয়েমেনের সুকাত্রা দ্বীপ আর আফ্রিকার অল্প কিছু এলাকায় জন্মায় এক বিচিত্রদর্শন গাছ। দেখতে অনেকটা সবুজ রঙের খোলা ছাতার মতো। একটাই লম্বা কাণ্ড, সেটা ওপরের দিকে বাড়তে বাড়তে অসংখ্য ডালপালায় ভাগ হয়ে যায়। সুকাত্রা দ্বীপের শুকনো মাটিতে জন্মানো এ গাছটি প্রায় ৩২ ফুট লম্বা হয়। শুকনো বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করার জন্যই না কি এমন ছাতার মতো চেহারা হয় গাছগুলোর।

আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন কোটি বছর আগে মূল আরব ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল সুকাত্রা দ্বীপপুঞ্জ। প্রকৃতির খেয়ালে তাই এখানে সভ্যতার বিবর্তনের ছাপ পড়েনি সেভাবে। সময় যেন থমকে আছে এই দ্বীপে। সভ্য মানুষ এই দ্বীপের নাম দিয়েছে ‘এলিয়েন আইল্যান্ড’ বা ভিনগ্রহীদের দ্বীপ। প্রাগৈতিহাসিক এই আইল্যান্ডে এখনও টিকে রয়েছে একেবারে অন্যরকম প্রজাতির হরেক প্রাচীন গাছপালা, যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। সেইসব অদ্ভুতুড়ে গাছের অন্যতম এই ড্রাগন ব্লাড ট্রি।

বিজ্ঞানীরা বলেন, এই ড্রাগন ব্লাড ট্রি পৃথিবীর আদিমতম গাছগুলোর একটা। প্রাণ সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত নানা প্রাকৃতিক ও মহাজাগতিক পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে এই গ্রহ। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গেছে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের জীবন। ডাইনোসরের মতো প্রজাতি একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ কেউ কেউ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বদলে নিয়েছে নিজেদের শারীরিক গঠন। কিন্তু এই ড্রাগন ব্লাড ট্রি না কি যুগ যুগ ধরে অপরিবর্তিত রেখেছে নিজেদের।

 

 ড্রাগন ব্লাড ট্রি। ছবি : সংগৃহীত

ড্রাগন ব্লাড ট্রি। ছবি : সংগৃহীত

এ গাছে কোনো বর্ষবলয় তৈরি হয় না। গাছের কাণ্ডের সংখ্যা দেখে এর বয়স নির্ধারণ করা হয়। গাছটি বছরে মাত্র একবারই মার্চ মাস নাগাদ ফুল দেয়। ফলও হয়, প্রায় আমাদের কুলের মতো দেখতে ছোট্ট ছোট্ট ফল। কাঁচায় সবুজ আর পাকলে কালো রঙের এই ফলগুলো বেশ মজা করেই খায় দ্বীপের পশুপাখিরা।

আপাত স্বাভাবিক এই গাছগুলো সত্যিই কি বংশ পরম্পরায় নিজেদের শরীরের ভেতরে বয়ে চলেছে ভয়ংকর এক হাজার মাথা ড্রাগনের অস্তিত্ব? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আগে জানতে হবে এই গাছের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন পুরাণকথাটি।

পৌরাণিক রোমান বীর হারকিউলিসের নাম জানেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষ হয়েও আশ্চর্য সব কাজকর্মের দৌলতে স্বর্গের অমর দেবতাদের মধ্যে নিজের জায়গা করে নিয়েছিল হারকিউলিস।

ইতিহাস বলে, মাইসিনির রাজা এম্ফিট্রাইওন আর আল্কমিনার ছেলে এই হারকিউলিস। একবার রাজা এম্ফিট্রাইওনের সঙ্গে তার কাকার কোনো এক বিষয়ে বিরোধ লাগে। কাকার ষড়যন্ত্রে মারা পড়ে এম্ফিট্রাইওন। তখন আল্কমিনা গর্ভবতী ছিল। সেই অবস্থাতেই নিজের আর সন্তানের প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে থিবসে পালিয়ে আসে, আর সেখানেই জন্ম দেয় হারকিউলিসের।

 

হারকিউলিস। ছবি : সংগৃহীত

হারকিউলিস। ছবি : সংগৃহীত

কিন্তু হারকিউলিসের জন্ম নিয়ে এই কাহিনির থেকে আরো বেশি জনপ্রিয় তার আর জিউসের গল্প। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, হারকিউলিসের আসল বাবা হলেন দেবতাদের রাজা জিউস। পৃথিবীর মেয়ে আল্কমিনাকে ভালবেসে ফেলেছিলেন জিউস। আর সেটা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি জিউসের স্ত্রী দেবী হেরা। হেরা প্রথম থেকেই দুচক্ষে দেখতে পারতেন না হারকিউলিসকে। হারকিউলিসের জন্মের সময় তাকে মেরে ফেলার চেষ্টাও করেন। হারকিউলিসের প্রসবে দেরি করিয়ে আগে তার ভাই ইউরেস্থিয়াসের জন্ম দেন, যাতে রাজার বড় ছেলে হিসাবে গ্রীসের সিংহাসন পায় ইউরেস্থিয়াস, হারকিউলিস নয়। শিশু হারকিউলিসকে মারার জন্যে দুটো সাপও পাঠায় দেবী হেরা। কিন্তু জিউসের পুত্র বীর হারকিউলিস সাপদুটোকে সহজেই মেরে ফেলে।

অন্যদিকে দেখলে হেরা বাদে অলিম্পাসের বাদবাকি দেবতারা সকলেই পছন্দ করতেন হারকিউলিসকে। হারকিউলিসের প্রতিটা যুদ্ধে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা। বিশেষ করে যুদ্ধের দেবী অ্যাথিনার খুবই প্রিয় পাত্র ছিলেন হারকিউলিস।

ছোটবেলা থেকেই অপরিমিত ক্ষমতার পাশাপাশি অসম্ভব রাগি আর বদমেজাজি ছিলেন হারকিউলিস। রাগের মাথায় বেশ কিছু ভুল কাজও করেন। যার ফলস্বরূপ কঠিন প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তাঁকে।

 

হারকিউলিসের বিয়ে হয় থিবসের রাজা ক্রিওর মেয়ে মেগারার সঙ্গে। ছবি : সংগৃহীত

হারকিউলিসের বিয়ে হয় থিবসের রাজা ক্রিওর মেয়ে মেগারার সঙ্গে। ছবি : সংগৃহীত

এরপর হারকিউলিস বড় হয়ে উঠলে তার বিয়ে হয় থিবসের রাজা ক্রিওর মেয়ে মেগারার সঙ্গে। বউ-বাচ্চা নিয়ে কয়েকবছর বেশ সুখেই সংসার করছিলেন হারকিউলিস। তার এই সুখ দেখে বুক জ্বলে যাচ্ছিল হিংসুটে দেবী হেরার। হারকিউলিসকে কষ্ট দিতে নতুন এক ফন্দি আঁটে সে। দৈবশক্তির বলে হারকিউলিসকে পাগল করে দেয় হেরা। সেই উন্মাদগ্রস্ত অবস্থায় একদিন বউ-বাচ্চাকে নিজের হাতে খুন করে হারকিউলিস। পরে স্বাভাবিক হয়ে সবটা বুঝতে পেরে যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ে সে। প্রাণাধিক স্ত্রী আর সন্তানদের হারানোর যন্ত্রণা তো ছিলই, তার পাশাপাশি নিজেকে সারাক্ষণ অপরাধী আর পাপী মনে হতে থাকে। সেই পাপস্খালনের জন্যে সে সাহায্য চায় আলোর দেবতা অ্যাপোলোর। অ্যাপোলো নিজেও হেরার হিংসা আর অত্যাচারের শিকার। হারকিউলিস আবার সম্পর্কে তার ভাই। সে হারকিউলিসকে বলে দেয় পাপমুক্তির উপায়। সে বলে হারকিউলিস যদি মাইসিনি, আরগোস ও টাইরিনসের রাজা ও তার বড়দাদা ইউরেস্থিয়াসের কাছে গিয়ে তার অধীনে কাজ করে, তাহলেই তার পাপমুক্তি সম্ভব।

এখান থেকেই আসল গল্পের শুরু। হেরার চক্রান্তে ইউরেস্থিয়াস একের পর এক কঠিনতম কাজের আদেশ দিতে থাকে হারকিউলিসকে। অসহায় হারকিউলিসও বাধ্য হয়ে হুকুম তামিল করতে থাকে। দেবতা-মানুষের অসাধ্য সেই কাজগুলোই পরবর্তীতে অমরত্ব এনে দেয় তাকে। হাউকিউলিসের জীবনে এমন ১২টি ভয়ংকর এডভেঞ্চারের কাহিনি রয়েছে, যার অন্যতম ড্রাগন ল্যাডনের গল্প।

হেসপেরিডিসের এক অজানা বাগান ছিল যেটা কোথায় কেউ জানত না, সেই বাগানে ছিল সোনার আপেল। হারকিউলিসকে তার দাদা আদেশ করলেন সেই অজানা বাগান থেকে তিনটে সোনার আপেল নিয়ে আসতে। হারকিউলিসের মতো বীরের পক্ষেও কাজটা প্রায় অসম্ভব ছিল, কারণ সেই সোনার আপেল রক্ষা করতেন স্বয়ং দেবী হেরা। হেরা তার এক পোষ্য ড্রাগন সেই আপেলের পাহারা দেওয়ার জন্যে রেখেছিল। সেই ড্রাগনের ছিল একশটা মাথা, আর খুবই ভয়ংকর আর নৃশংস ছিল সেই ড্রাগন ল্যাডন। সেই শতমুণ্ড ড্রাগনকে না মেরে আপেল ফিরিয়ে আনা অসম্ভব ছিল।

 

প্রবল লড়াইয়ের পর সেই ভয়ংকর ড্রাগনটিকে মারতে সক্ষম হয় হারকিউলিস। প্রতীকী ছবি

প্রবল লড়াইয়ের পর সেই ভয়ংকর ড্রাগনটিকে মারতে সক্ষম হয় হারকিউলিস। প্রতীকী ছবি

শুরু হয় ঘোর যুদ্ধ। প্রবল লড়াইয়ের পর সেই ভয়ংকর ড্রাগনটিকে মারতে সক্ষম হয় হারকিউলিস। ছিন্ন-শরীর ড্রাগনের গাঢ় লাল রক্ত ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। পরবর্তীতে সেই রক্ত থেকেই নাকি এই অদ্ভুত গাছের জন্ম। যে কারণে গাছটি আজ ড্রাগন ব্লাড ট্রি নামে পরিচিত।

বোটানিস্টরা বলছেন, রক্তের মতো দেখতে এই ঘন লাল আঠালো তরল আসলে রেজিন। এক ধরনের উপক্ষার। এই রেজিনের ঔষধিগুণ প্রবল। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রিস, রোম, আরবের ডাক্তারেরা জ্বর, আলসার আমাশা ও পেটের নানা রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করত গাছের এই ‘ড্রাগন-ব্লাড’। ১৮ শতকের দিকে এই আঠা ভায়োলিন বার্নিশের কাজেও ব্যবহার হতো। তা ছাড়া রঞ্জক হিসাবে, টুথপেস্ট তৈরি করতেও কাজে লাগানো হতো এই রক্তরং রেজিন। সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনও বহু মানুষ বিশ্বাস করেন এই আশ্চর্য গাছের ধমনিতে বইছে শতমুণ্ড ড্রাগনের রক্ত। আর তাই প্রেম, নির্বাসন এবং যৌনতার জন্য মন্ত্রের শক্তি বাড়াতে সেই প্রাচীনকাল থেকেই জাদুটোনা, তুকতাক আর অ্যাডলকেমির কাজেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই উপক্ষার।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন