ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ২৫ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

এক চতুর শিয়াল ও কাকের গল্প

প্রকাশিত: ১৬:৫৮, ২০ নভেম্বর ২০২১

এক চতুর শিয়াল ও কাকের গল্প

অনেক দিন আগের কথা। এক মরুভূমির পাশের গ্রামে একটি শিয়াল বাস করত। ওই বনের সব পশু-পাখির কাছে জ্ঞানীপণ্ডিত ও অভিজ্ঞ মুরব্বি হিসেবে শিয়ালের খুব নাম ডাক ছিল। শিয়াল হাঁস-মুরগী ও আঙুর বাগানের দুশমন হলে কী হবে- বনের অন্যান্য পশু-পাখি কিন্তু তাকে ভয় পেত না। কারো কোনো প্রয়োজন হলেই চলে আসত শিয়ালের কাছে। তার সঙ্গে বুদ্ধি-পরামর্শ করত।
 ওই বনে একজনের সঙ্গে তার খুব ভালো খাতির ছিল। সে ছিল এক দাঁড়কাক। উঁচু পাহাড়টির ওপরে তার বাসা। পাথরের গর্তেই সে বাসা করে নিয়েছে। শিয়াল যখনই পাহাড়ের ওদিকটায় আসত তখনি কাকের সঙ্গে বসে গল্প করত।
 একদিন শিয়াল বের হলো বনের পশু-পাশিদের সুখ-দুঃখের খবর নিতে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে শেষ পর্যন্ত পৌঁছল কাকের বাসায়। এসেই দেখে কাক মুখ গোমড়া করে বসে আছে। তার চেহারায় গভীর দুঃখ ও আতঙ্কের ছাপ। শিয়ালকে দেখে কাক চুপচাপ।
শিয়াল সালাম দিয়ে বলল: আসসালামু আলাইকুম। কি খবর বন্ধুব্যাপার কী হে! মনে হয় তোমার সময় ভালো যাচ্ছে না। তা হঠাৎ এমন কী ঘটল যেতুমি মন খারাপ করে বসে আছো?
শিয়ালের কথা শুনে এবার কাক মুখ খুলল এবং বলল- বন্ধু আমার! কী আর বলবমানশিক ভাবে বেস অশান্তিতে আছি । বেশ কদিন হলো এক উটকো বিপদ এসে পড়েছে আমার ওপর। আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ফেলেছে।
শিয়াল: কে সে , যে তোমার জীবনকে অতিষ্ঠ করে ফেলেছেযদি শক্তিতে কুলোয় তাহলে তার  চামড়া তুলে নেব।
 কাক: না ভাইতোমার শক্তিতে কুলোবে না। আমার শত্রু  এক মারাত্মক বিষধর সাপ। কদিন পর পর এসে হানা দেয় আমার বাসায় এবং আমার কলিজার টুকরো বাচ্চাদের এক একজন করে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলে। তুমি তার সাথে পারবে না। তার ঝগড়া করতে গেলেই ছোবল মারবে। তোমার ধারালো দাঁত থাকলে হয়তো কামড়াতে পারবে কিন্তু সে তোমার জিহ্বাতেই ছোবল দিবে
 শিয়াল:  তা তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু তোমার জোরও তো কম, তুমি তো তাকে কিছুই করতে পারবে না। তাহলে কিছু ভেবেছো?
 কাক: আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি প্রতিশোধ নেবই। যদি সফল হই তো বিপদমুক্ত হলাম। তা না হলে মরণ তো একবার হবেই । একবারই মরবএকবারই কাঁদব। যদি তার ভয়ে সবসময় চুপ করে থাকি তবে সে  আমাদের কাউকেই রেহাই দেবে না। আমরা কখনো শান্তিতে থাকবে পারব না।
 শিয়াল: আরে ভাইতুমি তো সাপের সাথে যুদ্ধ করে টিকতে পারবে না। সাপ যদি তোমার গলা পেঁচিয়ে ধরে তাহলে নির্ঘাত দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।
 কাক: তুমি ঠিকই বলেছো। তবে আমি এত বোকা নই যেআমি সাপকে গিয়ে বলব- হে সাপ! একটু সবুর করোচুপচাপ বসে থাকোআমি তোমাকে মারবো।
 শিয়াল: তাহলে কিভাবে সাপকে মারতে চাচ্ছ তুমি?
 কাক: আমি যখন দেখব যেসাপ ঘুমিয়ে আছে তখন তার উপর অতর্কিত হামলা করব। আমার ঝারালো  নখ দিয়ে তার চোখ উপড়ে ফেলব। অন্ধ হয়ে গেল সাপ আর চোখে দেখতে পারবে না এবং আমার বাসাও খুঁজে পাবে না। বাসা খুঁজে না পেলে আমার কলিজার টুকরো বাচ্চারাও আর মারা পড়বে না। তুমি কী বলো- শিয়াল ভাইআমার পরিকল্পনা কি ঠিক আছে?
 কাকের পরিকল্পনা শুনে শিয়াল কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল-
 শিয়াল: না ভাইএ কাজ করতে যেও না। এতে সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই কম। যদি সাপ ঘুম থেকে সজাগ হয়ে যায় এবং তোমাকে দেখে ফেলে আর তুমি তাকে অন্ধ করে না দিতে পারো তাহলে সে তোমার প্রতি ভীষণ ক্ষেপে যাবে। এখন হয়তো শুধু খাওয়ার লোভে তোমার বাসায় আসে কিন্তু তখন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আসবে এবং অনেক বেশি ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।
 কাক: তাহলে বলো আমি এখন কী করতে পারি?
 শিয়াল: আমি বলি কি জানোএমন কাউকে সাপের সাথে লড়াইয়ে পাঠাও যার গায়ে জোর আছে। দেখো না মানুষ নেকড়ের সাথে লড়াই করার জন্য সব সময়ই মেষপালের সাথে কুকুরও রাখে। মানুষের বুদ্ধি হলো এই যেতারা দুই দুশমনকে পরস্পর লেলিয়ে দেয়। এতে করে এই দুই দুশমনের একজন অন্তত শেষ হয়ে যায় এবং অন্যজন মানুষের বশে আসে। এতে মানুষ নিরাপদ থেকে যায়।
 কাক: তোমার দৃষ্টিতে পশুদের মধ্যে কার এমন জোর আছে যেসাপের সাথে পেরে উঠবেকে এক হাতে সাপের মুণ্ডু ধরে অন্য হাতে তার গলা ছিঁড়ে ফেলতে পারবেবিড়াল হয়তো পারত কিন্তু বিড়ালের সঙ্গে আমার তেমন বন্ধুত্ব নেই। এখন কী করি তাই বলো।
 বিড়াল: বেশ ভালো কথা। বিড়াল ছাড়াও কেউ থাকতে পারে। তাছাড়া,  বিড়াল যদি বন্ধু হতো তা হলেই কি তাকে লড়াইয়ের ময়দানে পাঠানো যেতদুনিয়ার কোনো কাজ কখনো শুধু করে করা যায় না। সবাই তার স্বার্থ দেখতে চায়।
 কাক: তাহলে তুমিই বলোকোন পশুকে পাঠাতে পারি সাপকে বধ করতে?
 শিয়াল: পশু দিয়ে কাজ হবে না বরং মানুষ পাঠাতে হবে। মানুষই পারে সাপকে মেরে টুকরো টুকরো করতে।
 মানুষের কথা শুনে কাক খানিকটা অবাক হয়ে গেল। এরপর শিয়ালকে উদ্দেশ করে বলল:
 কাক: তুমি হয়ত ঠিকই বলেছো কিন্তু কাকের বাচ্চার জন্য মানুষের কেন এত দয়া হবে যেতারা ছুটে আসবে সাপ মারতে?
 শিয়াল: কাকের বাচ্চার জন্য মানুষের দরদের প্রয়োজন নেই। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই ছুটে আসবে সাপ মারতে। সাপ যেমনি কাকের শত্রুতেমনি মানুষেরও শত্রু। মানুষ যেই জানতে পারবে এখানে সাপ বাসা বেঁধেছে অমনি ছুটে আসবে সাপ মারার জন্য।
 কাক: তা না হয় বুঝলাম কিন্তু মানুষ কিভাবে জানবে যেএই পাহাড়ে সাপ আছে।
 শিয়াল: মানুষ নিজের ইচ্ছায় জানবে নাতাদেরকে জানানোর দায়িত্ব আমাদের।
 কাক: আমরা কিভাবে জানাবোআমরা তো মানুষের ভাষা জানি না!!
 শিয়াল: ভাষা না জানলেই যেমানুষকে জানানো যাবে না ব্যাপারটা এমন নয়। যেকোনো সমস্যার সমাধান আছে। প্রয়োজন শুধু চিন্তা-ভাবনা করা। আল্লাহ আমাদের মাথায় যে বুদ্ধি দিয়েছেন তা খাটাতে হবে।
 কাক: তা তো ঠিকই বলেছো। কিন্তু
 শিয়াল: কোনো কিন্তু নয়। শোনোআমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। তুমি উড়ে যাবে পাশের গ্রামে। এরপর মানুষের ঘরবাড়ি বা উঠোন থেকে কোনো হালকা পাতলা কিন্তু দামী জিনিস ছো মেরে উঠিয়ে নেবে। তা ঠোঁটে নিয়ে এমনভাবে উড়তে থাকবে যাতে মানুষ তোমাকে দেখতে পায়। এরপর জিনিসটি নেয়ার জন্য লোকজন তোমার পিছু পিছু দৌড়াতে থাকবে। তুমিও এমনভাবে আস্তে আস্তে উড়বে যেন মানুষ নিরাশ না হয়। এরপর পাহাড়ের ওপর এসে যেখান সাপকে দেখবে সেখানে জিনিসটা ফেলবে। এরপর তোমাকে আর কিছুই করতে হবে নাবাকি কাজ মানুষই করবে।
 শিয়ালের কথা শুনে কাক আনন্দে নেচে উঠল। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল:
 কাক: তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ শিয়াল ভাই। তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করে শেষ করতে পারব না। আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন।
এই বলে কাক পাখা মেলল আকাশে। উড়ে গেল পাশের গ্রামে। এক বাড়িতে দেখল একদল মেয়ে বসে গল্প-গুজব করছে। একজন মহিলা একটি সুন্দর জামা সবাইকে দেখাচ্ছে। জামাটি বেশ মূল্যবান এবং নতুন বলে মনে হলো। কাক ভাবল এটি ছো মারা সহজ হবে। একটি ছোট বালিকা জামাটি দেখার জন্য হাতে নিতেই কাক তা ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। জামার একটি হাত কামড়ে ধরে কাক ছুটল পাহাড়ে দিতে। মহিলাদের চিল্লাচিল্লি ও ছুটাছুটিতে গ্রামে পুরুষও ছুটল কাকের পিছু পিছু। এমন আজব কাণ্ড দেখে গ্রামসুদ্ধ মানুষ ছুটল পাহাড়ের দিকে। তাদের ধারণা- কাক বেশিদূর জামাটি নিয়ে যেতে পারবে নাএক জায়গায় গিয়ে ক্লান্ত হবেই।
এদিকেকাক আঙুর বাগান পার হয়েই দেখতে পেল সাপকে। লোকজন আসার অপেক্ষায় পাহাড়ের উপর কয়েকটি চক্কর দিল। যেই দেখল যেমানুষজন পাহাড়ের কাছে পৌঁছে গেছে অমনি কাক তার মুখের জামাটি ছুঁড়ে ফেলল সাপের গায়ের উপর। কাপড় দেখেই মানুষজন ছুটল কাপড়ের দিকে। ওদিকে সাপও প্রথমে চমকে উঠল। লোকজন এসেই সাপ দেখে থমকে দাঁড়াল। তাড়াতাড়ি ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে দূরে সরিয়ে লাঠি-সোটা ও ইট-পাথর নিয়ে হামলা চালাল সাপের উপর। সাপকে মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলল। কোত্থেকে এক চিল এসে ছোঁ মেরে সাপের টুকরোগুলোকে নিয়ে গেল। লোকজন এসে জামাটি উদ্ধার করে আনন্দ করতে করতে গ্রামের দিকে গেল।
 সাপের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর উড়াল দিয়ে সোজা চলে গেল শিয়ালের কাছে। শেয়ালকে সব ঘটনা খুলে বলল এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাল।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন