ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

ইসলামে মজুতদারির শাস্তি

প্রকাশিত: ১৮:০২, ২৭ মার্চ ২০২৩

ইসলামে মজুতদারির শাস্তি

প্রতীকী ছবি

খাদ্যশস্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কম দামে ক্রয় করে, বেশি দামে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে জমা করে রাখাই হলো ‘মজুতদারি’। শব্দটির আরবি প্রতিশব্দ ‘ইহতিকার’। মজুতদারি ইসলামে নিষিদ্ধ। 

এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদিসে অনেক সতর্কবাণী উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিম শরীফে, ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিসের বক্তব্য হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মজুতদারি করে, সে পাপী।’ (মুসলিম, হাদিস নম্বর ১৬০৫)

হাদিসের একটি প্রসিদ্ধ কিতাব, বায়হাকী শরীফে, মায়া‘জ ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মজুতদার অতি নিকৃষ্ট ব্যক্তি, আল্লাহ তা‘আলা যদি (জিনিসপত্রের দাম) সস্তা করে দেন, তাহলে এই ব্যক্তি অনুতাপ এবং দুঃখ প্রকাশ করে, আর যদি দাম বাড়িয়ে দেন, তা হলে সে আনন্দিত হয়ে যায়।’

সুনান আবু দাউদ শরীফে ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মক্কা এলাকায় মজুতদারী কুফরীর সমতুল্য।’ 
সুনান ইবন মাজাহ শরীফে বর্ণিত একটি হাদিসের বক্তব্য অনুযায়ী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পণ্য আমদানীকারক রিযিকপ্রাপ্ত, আর মজুতদার অভিশপ্ত।’ (ইবন মাজাহ, হাদিস নম্বর ২১৫৩)

উল্লিখিত হাদিসগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মজুতদারি এক কথায় নিষিদ্ধ। তারপরও মজুতদারি করে সমাজের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী লাভবান হন। এরা নিঃসন্দেহে অসাধু ব্যবসায়ী। এটি ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্হিত কাজ, মহাপাপ এবং অবশ্যই এটি দুর্নীতি। 

একটি হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানলাম যে, ‘যারা আমদানি করে তারা রিযিকপ্রাপ্ত।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি দেশের মানুষের সুবিধার জন্য, ভোক্তার সুবিধার জন্য, বাইরে থেকে যে কোনো সম্পদ, যে কোনো খাদ্য-দ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করে, তাকে আল্লাহ রিযিকের ব্যবস্থা করে দেন। এই অর্থে যে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন, আর সুদকে করেছেন হারাম’। 

কুরআনের এই বাণী থেকেও আমরা জানতে পারি, ব্যবসা অবশ্যই বৈধ এবং এটা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। তবে আমদানি করা পণ্য সামগ্রী বা মালামাল যখন কম দামে আমদানি করে, বেশি দামে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে মজুত করা হয় এবং মজুত করে বাজারে কৃত্রিম  সংকট তৈরি করা হয়, পণ্য প্রবাহের গতি কমিয়ে দেয়া হয়; এর ফলে বাজারে চাহিদার বিপরীতে ওই পণ্যের তীব্র অভাব অনুভূত হয়, আর তখনই মজুতদার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ওই পণ্যের মূল্য হুহু করে বাড়িয়ে দেয় তাহলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি ইসলামের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমাদের দেশেও মজুতদারদের প্রশ্রয় দেয়ার আইন কোথাও নেই। তারপরও আমাদের দেশে যারা মজুতদারির চর্চা করে তাদের দাপটই হাট-বাজারে বেশি প্রতীয়মান হয়।

রমজান মাস দুয়ারে। রমজান মাস মহিমান্বিত মাস। এ মাসে রোজা রাখার জন্য মু’মিন মুসলিম সবাই চেষ্টা করে। আর এই রোজার মাসে একটু খাঁটি খাবার খাওয়ার জন্য, বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার জন্য, সুষম খাদ্য খাওয়ার জন্য, স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখার জন্য অনেকেই চেষ্টা করে। কিন্তু এই রোজার মাসকে সামনে পেয়ে এক শ্রেণীর মজুতদার পণ্যসামগ্রী আটকে রেখে, বাজারে সিন্ডিকেটের আশ্রয় নিয়ে, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। তারা রোজাদারদের বা সাধারণ ক্রেতাদের কষ্ট দেয়। এর ফলে ১০০ টাকার পণ্য কখনও ২০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। আবার কখনও ৩ গুণ বা ৪ গুণ অর্থ দিয়ে ক্রয় করতে গেলেও কোনো কোনো পণ্য বা খাদ্য বাজারে পাওয়া যায় না। এ সবই গর্হিত কাজ, শাস্তিযোগ্য কাজ। আর তাই ইসলামের দৃষ্টিতে কঠোর শাস্তি মজুতদারদের জন্য অপেক্ষা করছে। 

যারা মজুতদারির আশ্রয় নেয়, তাদের অন্তর থেকে আল্লাহ ভীতি দূর হয়ে যায়। বাজার সংকট তৈরি করার ক্ষেত্রে তাদের মনের মধ্যে পঙ্কিলতার সৃষ্টি হয়। তারা মানবিকতার বিরুদ্ধে কাজ করে। পরবর্তীতে তারা দান-সদকার মাধ্যমে চেষ্টা করে পূণ্য হাসিলের জন্য। কিন্তু এই দুর্নীতি, অন্যায় ও অত্যাচারের পর, এই দান-সদকা কখনোই তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে আল্লাহর কাছে উপস্থাপিত হবে না। আল্লাহ তাকে অবশ্যই মজুতদারির কঠিন শাস্তি দেবেন।

শুধু তাই নয়, মজুতদারির সহায়তা যারা করে তাদের জন্যও কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। (মুসনাদ আহমদ ১৯৪২৬ নম্বর হাদিসের মাধ্যমে) আমরা জানতে পারি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুসলিম জনগণের জন্য, পণ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, যদি কেউ কোনো রুপ  হস্তক্ষেপ করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলার অধিকার হলো, তিনি কিয়ামতের দিন তাকে (মজুতদারি বা তার সহায়তাকারীকে) জাহান্নামের একটি ভয়ঙ্কর স্থানে আগুনের ওপর বসাবেন।’

 

হাদিসটির মর্মার্থ স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায়। এখানে মজুতদারির শাস্তি তো রয়েছেই, এই মজুতদারিতে যারা সাহায্য করছেন, তারাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। এই ক্ষেত্রে যদি মজুতদারকে কেউ গুদাম ভাড়া দেয়, তাহলে তারও শাস্তি হওয়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। মজুতদারির উদ্দেশ্যে যারা পণ্যসামগ্রী গুদামজাত করে, গুদাম পাহারা দেয়, সকলেই এই শাস্তির আওতায় রয়েছে। দেশের সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যারা এই মজুতদারি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করছেন, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে, তাদের ওপরও এই শাস্তি প্রযোজ্য বলে ধরে নেয়া যায়।  

অতএব কোনোভাবেই রোজার মাসে যাতে মজুতদারি করে আমরা রোজাদারকে কষ্ট না দেই, সাধারণ মানুষকে কষ্ট না দেই সে জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। দুনিয়ার শাস্তি হয়তো আমরা এড়িয়ে যেতে পারলাম, কিন্তু আখেরাতের শাস্তি অবশ্যই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কেউই আমাদের এই পরকালীন শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না। 

মনে রাখতে হবে, মজুতদারদের ব্যবসায় আল্লাহ তা‘আলা যে কোনোভাবে ক্ষতির মাধ্যমে নষ্ট করে দিয়ে দুনিয়াতেও এর শাস্তি প্রদান করতে পারেন। হয়তো মজুদদারের কোনো পণ্য সামগ্রী নষ্ট হলো না, কিন্তু তার অন্য সম্পদ নষ্ট করে দিয়ে, আত্মীয় স্বজনের মধ্যে অসুখ-বিসুখ, মহামারী ইত্যাদি দিয়ে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়াতেই শাস্তি দিতে পারেন। কাজেই কোনোভাবেই আমরা মজুতদারকে সহযোগিতা করব না। মজুতদারকে ঘৃণা করব। এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও আমরা ঘৃণা করব। 

আসন্ন রোজার মাসে রোজাদার এবং সাধারণ মানুষদের যাতে খাবারের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করি, সেজন্য আমরা সচেষ্ট থাকব। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন!

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও মাসিক পত্রিকা সম্পাদক