ঢাকা,  শুক্রবার  ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

সম্প্রীতি সমাবেশে ভ্রাতৃত্ব রক্ষার অঙ্গীকার

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২৮ অক্টোবর ২০২১

সম্প্রীতি সমাবেশে ভ্রাতৃত্ব রক্ষার অঙ্গীকার

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। সুদীর্ঘকাল থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন বহন করছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কবর দিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। 

মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন, সবাই এদেশের নাগরিক। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সমঅধিকার ভোগ করবেন, কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকগণ নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেয়। যার কুফল আজও ভোগ করছে এদেশের জনগণ।
অতিসম্প্রতি শারদীয় দুর্গোৎসবকে পণ্ড করতে কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপ ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ ও বাড়িঘর লুটপাট করেছে একদল সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী। প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রগতিশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো গর্জে উঠেছে। প্রতিটি সংগঠনই আলাদা আলাদা করে কর্মসূচী পালন করে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সম্প্রীতি বাংলাদেশ। 

গত ২৫ মে সম্প্রীতি বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্প্রীতি সমাবেশের আয়োজন করে। ‘সম্প্রীতি সমাবেশে'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, উদিচি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্য জোট, মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামি জোট, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যাণ পরিষদ, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নসহ ৯৩টি প্রগতিশীল সংগঠন সংহতি প্রকাশ করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে যৌথ বিবৃতি ঘোষণা করে। ছাত্র-শিক্ষক, পেশাজীবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সর্বস্তরের জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে জনসমাবেশটি মহাসমাবেশে পরিণত হয়। 

সংগঠন গুলোর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সাত দফা দাবি পেশ করেন সমাবেশের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। দাবিগুলো হচ্ছে- (১) সাম্প্রতিক ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা; (২) অতীতের ঘটনার দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা; (৩) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনা আর যেন না ঘটে সেজন্য প্রশাসনকে আরও বেশি তৎপর হওয়া, (৪) সাম্প্রতিক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি-ঘর এবং উপাসনালয় দ্রুত সংস্কারের ব্যবস্থা করা; (৫) মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদসহ শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধ ও সহনশীলতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা; (৬) আবহমান বাংলার সংস্কৃতি চর্চায় তরুণ ও যুব সমাজকে অধিকতর সম্পৃক্ত করতে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া; (৭) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও উসকানি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।

বাংলাদেশ যে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে লালন করে এবং সাম্প্রদায়িকতার স্থান যে এদেশের মাটিতে নেই সে কথাটি সমাবেশে উপস্থিত বক্তাদের বক্তব্য থেকে জোরালো ভাবে উঠে আসে।

সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশে সম্প্রীতি বিনষ্টকারী যেকোনও অপশক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উজ্জীবিত মানুষ যে একনিষ্ঠ থাকে, আজকের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের এই সম্প্রীতি সমাবেশ তারই প্রমাণ। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যখন যেখানে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবে, সেখানেই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। শান্তি ও পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যে প্রতিটি ধর্মের মর্মকথা সেটি ধর্মীয় প্রতিনিধিদের বক্তব্য থেকে সুন্দরভাবে উঠে এসেছে।

সিদ্ধাশ্রম মঠের অধ্যক্ষ স্বামী দেবানন্দ মহারাজ এ প্রসঙ্গে বলেন, “যারা ধর্মকে ব্যবহার করে, অন্যায় কাজ করে, তারা কোনো ধার্মিক ব্যক্তি নয়, তারা দুষ্কৃতকারী।”

বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, “দেশে পরমতসহিষ্ণুতা রক্ষায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কুমিল্লার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ইকবাল হোসেনের গডফাদারদের এবং সাম্প্রদায়িক হেফাজতি-জামায়াতি অপশক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে।”

ব্যাপটিস্ট চার্চ সংঘের সভাপতি রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী বলেন, “সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাঙালি জাতিসত্তার ওপর মস্ত বড় আঘাত। মানুষের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম হচ্ছে মনুষ্যত্ব। বাংলাদেশে সেই প্রকৃত ধর্ম আজ লুণ্ঠিত ও পদদলিত হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে আজকে লড়াই করতে হবে।”

বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের মহাসচিব পি আর বড়ুয়া বলেন, “আমাদের বড় পরিচয় আমরা বাঙালি। এখানে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো পরিচয় হতে পারে না।”

সমাবেশে শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক নুজহাত চৌধুরী একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন- ঘরের ভেতর বিভীষণ ঢুকে গেছে। যারা সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে দেশকে মিনি পাকিস্তান করতে চায়, তাদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিদের ভেতর ঢুকে গেছে। এই বক্তব্যের প্রমাণ কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে। রংপুরের হামলায় যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সে ছাত্রলীগের একজন ছদ্মবেশী কর্মী। একজন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী কখনো এই ধরনের সাম্প্রদায়িক কাজ করতে পারে না। ঘরের শত্রু বিভীষণদের চিহ্নিত করতে হবে। নতুবা কোনো উদ্যোগই সফল হবেনা।

শহীদ মিনারে ‘সম্প্রীতি সমাবেশ’ অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একসঙ্গে ৯৩টি সংগঠনের একটি প্ল্যাটফরম বাংলাদেশে নজিরবিহীন। সমাবেশে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। শতাধিক গণমাধ্যম সংবাদ পরিবেশন করে দেশ-বিদেশের কোটি কোটি  মানুষের কাছে সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দিতে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্বল্প সময়ের মধ্যে পঞ্চাশের অধিক বক্তাকে বক্তব্যের সুযোগ দেয়া এবং এত বিশাল জনসমাবেশকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন সংগঠনের সদস্য সচিব ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল।

সম্প্রীতি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সকল ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশার মানুষকে একত্র কাজ করার একটি প্ল্যাটফরম। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে নিরন্তরভাবে কাজ করে যাচ্ছে। 

সমাবেশে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে বরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব ও সম্প্রীতি সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দোপাধ্যায় বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সকলে যদি আমরা সম্মিলিতভাবে দাঁড়াই, এই দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিষদাঁত আমরা ভেঙে দেবই দেব। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হয়ে, এই দেশের চলমান হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িকতা,সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্ব আমরা রক্ষা করবই।”

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রতিবাদী জনতার সম্প্রীতির বার্তা সারা দেশে পৌঁছে  দিতে হবে। প্রতিটি সংকটে জনগণের পাশে থেকে যেভাবে সম্প্রীতি বাংলাদেশ কাজ করেছে ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার এই সংগ্রামেও নেতৃত্ব দিতে হবে। গুটিকয়েক ধর্ম ব্যবসায়ীর কাছে বাংলাদেশ পরাজিত হবে না। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনাই বাংলাদেশের শক্তি। এই দেশ হবে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার।
 
কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়-
‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।’
লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন