ঢাকা,  বুধবার  ২৪ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

গুজবের ট্র্যাজিক দংশন ৭ নভেম্বর

প্রকাশিত: ১৫:০৮, ৭ নভেম্বর ২০২১

গুজবের ট্র্যাজিক দংশন ৭ নভেম্বর

৭ নভেম্বর ১৯৭৫। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সব ঘটনা ঘটে, যেখানে এক গুজবে জড়িয়ে আছে দুটো অভ্যুত্থান। একটি অভ্যুত্থান ১২০ ঘণ্টার ব্যবধানে ব্যর্থ, অপরটি অনেক দিনের পরিকল্পনায় সফল।
ক্ষমতায় বসার ৮ দিন পর ১৯৭৫-এর ২৪ আগস্ট জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ করে খন্দকার মোশতাক। তবে জিয়ার মতিগতির প্রতি মোশতাক বা মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানীর মোটেই বিশ্বাস ছিল না। ওসমানী আর জিয়ার মধ্যে কথাবার্তাও হতো না। যদিও আগস্ট ট্র্যাজেডি যারা ঘটায় তাদের ইচ্ছাতেই সরকার চলত। তারাই মোশতাককে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করিয়ে নিচ্ছিল।
চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ এবং ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার শাফায়াত জামিল বার বার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বঙ্গভবনের ঘাড়ে চেপে বসা মেজরদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়ার কথা জানিয়ে আসছিলেন। তা কীভাবে হবে? জিয়া যে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তারাই তো তাকে সেনাপ্রধান বানায়। কাজেই জিয়া তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে তো গেলেনই না, বরং কৌশলে সবদিক সামাল দিয়ে যাচ্ছিলেন।
জিয়া একহাতে ফারুক-রশীদের পিঠ চাপড়ানোর পাশাপাশি প্রতিবাদী শাফায়াত জামিলের কাঁধে ছিল তার আরেক হাত। ওদিকে আবার সবার অগোচরে জাসদের কর্নেল তাহেরের সঙ্গেও অনেকদিন ধরে যোগাযোগ রেখে আসছিলেন। জিয়াকে সামনে রেখে চাইনিজ পদ্ধতির সেনাবিপ্লবের স্বপ্ন দেখছিলেন জাসদের আর্মস উইং গণবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত কর্নেল তাহের। তবে জিয়া ছিলেন গভীর জলের মাছ। বহুদিন গোয়েন্দা সংস্থায় চাকরি করায় অনেকগুলো দিক সামলে চলায় ছিলেন পারদর্শী।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন ঘোলাটে হয়ে উঠছিল। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠছিল অনেকেই। এমনকি খোদ খন্দকার মোশতাক গং ও জিয়াকে সেনাপ্রধান বানানেওয়ালা ফারুক-রশীদ গংও জিয়ার সততা নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে। লে. কর্নেল (অব.) এমএ হামিদ তার ‘তিনটি সেনা-অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইতে জানিয়েছেন-
“রশীদ তার সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছে, জিয়া এই সময় সরাসরি দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।” (পৃ.৭৭)
এর মধ্যেই ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ রাত একটার সময় ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লার নেতৃত্বে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন জিয়াকে গৃহবন্দি করে ফেলে। তার বাসার টেলিফোন লাইনও কেটে দেয়া হয়। এ অভ্যুত্থানে একটি বুলেটও ফায়ার হয়নি। একটি প্রাণীও মারা যায়নি। জিয়াকে তার বাসভবনে বন্দি করার পরই খালেদ মোশারফকে অভ্যুত্থানের খবর দেয়া হয়। তিনি তখন ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম থেকে উঠে সরাসরি ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে ছুটে আসেন। যেহেতু অধীনস্থ সৈনিকরা একটা কাণ্ড ঘটিয়েই ফেলেছে, কাজেই ওটাকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন খালেদ মোশাররফ।
“৩ নভেম্বর সকালে ৪র্থ বেঙ্গল হেডকোয়ার্টারে বসে অভ্যুত্থানকারী অফিসারদের উপস্থিতিতে খালেদ মোশাররফ একটি দাবিনামা প্রস্তুত করেন। তার তিনটি দাবি ছিল-
১. ট্যাংক ও কামান বঙ্গভবন ও শহর থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠাতে হবে
২. জিয়া এখন থেকে আর চিফ অব স্টাফ নন
৩. বঙ্গভবনে বসে ফারুক-রশীদের কার্যক্রমের অবসান ঘটবে। তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে ‘চেইন অব কমান্ড’ মানতে হবে। খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট থাকবেন।”
(সূত্র: তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা- পৃ. ৮১)
ক্যান্টনমেন্টে রক্তপাত না হলেও অভ্যুত্থানের মাত্র আড়াই ঘণ্টা পর শেষ রাতেই রক্তবন্যা বয়ে যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বঙ্গভবনের নির্দেশে সরাসরি ব্রাশ ফায়ারে জেলখানার ভিতর হত্যা করা হয় বন্দি থাকা জাতীয় চার নেতাকে।
জেলখানায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো ফারুক-রশীদ যখন বুঝতে পারে এ ঘটনা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের আওতায় পড়বে না, তখনই চরম উৎকণ্ঠায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তারা। বিশেষ করে রশীদ বুঝতে পারে এ ঘটনা প্রকাশ পেলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাশেদ-মোশাররফও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন। কাজেই সেনানিবাসে ফেরত না গিয়ে, বিদেশে চলে যাওয়াই নিরাপদ মনে করে তারা।
শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবন ও সেনানিবাস- দুই পক্ষের সম্মতিতে ৩ তারিখ সন্ধ্যার সময় ফারুক-রশীদ গংয়ের ১৭ সদস্য রাত পৌনে নয়টায় বিমানে করে দেশ ত্যাগ করে। আর তাদের দেশত্যাগের পরই জেলহত্যার ঘটনা জানতে পারেন রাশেদ, মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল।
৩ থেকে ৭ নভেম্বর। খুব দ্রুত ঘটতে থাকে সবকিছু। অথচ এসব ঘটনা জানার কোনো সুযোগ ছিল না কারো। বেতার স্টেশন বন্ধ। সাধারণ মানুষ অন্ধকারে। সেনানিবাসের সাধারণ সৈনিকরাও বুঝতে পারছিল না, কী ঘটতে যাচ্ছে!
এর মধ্যেই খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান করা হয়। যদিও তার দাবিনামায় নিজেকে সেনাপ্রধান করার কথা উল্লেখ ছিল না। কিন্তু যেহেতু তারই অধীনস্থ সেনা অফিসাররা অভ্যুত্থান ঘটায়, কাজেই এখান থেকে নিজেকে আর দূরে সরিয়ে রাখতে পারছিলেন না খালেদ। তবে তিনি সেনাপ্রধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুজবের পালে হাওয়া লাগতে শুরু করে।
যদিও বেশ কিছুদিন ধরেই পাল তুলেছিল গুজব। শুরুটা হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিরা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে নানারকম গুজব ছড়িয়েছিল নিজেদের বাঁচানোর জন্য। এরপর যখন পাল্টা অভ্যুত্থান হয়, সবাই ধরে নিয়েছিল সেটা বিপরীত গোষ্ঠীর কাজ।
“সেনানিবাসে ৩রা নভেম্বর থেকে গুজবের সূত্রপাত হয় যে, এ অভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের অনুকূলে করা হয়েছে। কিন্তু তখন এসব গুজব বন্ধ করার জন্য সিনিয়র অফিসাররা কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি। এক কথায় ১৫ই আগস্টের পরিবর্তনকে তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর সিংহভাগ সদস্যই মনে প্রাণে গ্রহণ করে বিশেষ করে যখন ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করা হয়। আর আগস্ট অভ্যুত্থানকে দেখা হয় Anti Indian পদক্ষেপ হিসেবে।”
(সূত্র: বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায়-পৃ ৮৮)
ঠিক ওই সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যেসব ঘটনাকে ঘিরে তৈরি করা গুজবগুলোর সবই ছিল খালেদ মোশাররফের বিপরীতে। ৪ নভেম্বর এ অভ্যুত্থানের পক্ষে মিছিল ও মিটিংয়ের আয়োজন করে আওয়ামী লীগকর্মীরা। খালেদ মোশাররফের মা ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী আর ভাই রাশেদ মোশাররফ ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। গুজব রটনাকারীদের এটা বাড়তি সুবিধা দিয়েছে নিঃসন্দেহে। গুজবের পালে জোড়ালো হাওয়া টের পাওয়া যায়, যখন গুজব শোনা যায় এ অভ্যুত্থানের পিছনে ভারতের হাত রয়েছে।
ঘটনা প্রত্যক্ষকারী সাখাওয়াত তার বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায় বইয়ে জানিয়েছেন-
“এ ধারণা বা এরূপ গুজবের না ছিল কোনো ভিত্তি না ছিল সত্যের সাথে এর কোনো সম্পর্ক।... আজও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি খালেদ মোশাররফ, সাফায়াত (শাফায়াত) জামিল এবং অন্যান্য যারা এ অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের কারো সাথে তৎকালীন আওয়ামী লীগের কোনো নেতৃবৃন্দের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আর ভারতের সাথে যোগসাজস থাকার ধারণা অমূলক। খালেদ মোশাররফ, সাফায়াত (শাফায়াত) জামিল ও অন্যান্যরা যে ধরনের দেশপ্রেমিক ও যুদ্ধে তাঁদের যে অবদান রয়েছে, সেখানে এঁদের সম্বন্ধে এ ধরনের ধারণা পোষণ করা অত্যন্ত Unjustified। হয়ত কিছু কাকতালীয় ঘটনা সে সময়ে ঘটতে পারে।” (পৃ. ৮৯)
৪ নভেম্বর বিকেলে ভারতীয় দূতাবাসের ডিফেন্স অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার ভোরা গিয়েছিলেন সেনানিবাসের প্রধান প্রবেশ পথে। সেখানে গিয়ে তিনি খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু যেহেতু এ সাক্ষাৎকারের কোনো পূর্বানুমতি ছিল না, কাজেই মিলিটারি পুলিশ তাকে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি এবং চলে যেতে বলে। তবে চলে যাওয়ার আগে ব্রিগেডিয়ার ভোরা শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে একটি প্যাকেট রেখে যান খালেদ মোশাররফের জন্য।
“কিন্তু ভাগ্যের এমনি পরিহাস যে, সে প্যাকেটে কী ছিল তা দেখার সময় তিনি পাননি। ভোরার আগমন এবং এ সংকটময় মুহূর্তে খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা করার কারণ কেউই জানতে পারল না। কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে এ ঘটনা খালেদ মোশাররফের Pro-Indian হওয়ার গুজবে আরও ইন্ধন যোগায়। ভোরার আগমন কি সম্পূর্ণ কাকতালীয় বা ইচ্ছে করেই সেদিন ব্রিগেডিয়ার ভোরা খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন তা কেউই জানতে চাইল না।” (বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায়-পৃ. ৯১)
৬ নভেম্বর দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। আর ওদিকে গুজবে গুজবে সয়লাব ঢাকা। সুযোগটা নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গুপ্তদল। গুজবে ভরা প্রচারপত্র বিলি হতে থাকে। এমনকি সশস্ত্রবাহিনীর ভিতরেও বিভিন্ন মতবাদের প্রচুর প্রচারপত্র বিতরণ শুরু হয়ে যায়। এর প্রায় সবগুলোতেই খালেদ মোশারফকে Pro-Indian হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
গুজবকে ভিত্তি করেই ৬ নভেম্বর পেরিয়ে ৭ নভেম্বরের শুরুতে রাত বারোটার পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সিপাহিরা বিদ্রোহ করে বসে। সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ তখন বঙ্গভবনে। ফোনে সেই বিদ্রোহের খবর শুনে পালাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্নেল হুদা ও হায়দারের সঙ্গে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তখন দ্বিতীয়বারের মতো সেনাপ্রধান হওয়া জিয়াউর রহমান। খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হওয়ার আগেই তিনি আগেরবারের সেনাপ্রধান পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
৪ নভেম্বর ভারতীয় দূতাবাসের মিলিটারি অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার ভোরা যে প্যাকেটটি দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটি তার কার্যালয়ে টেবিলের উপর পড়ে ছিল বড্ড অবহেলায়। কী ছিল সেই প্যাকেটে? প্যাকেটে ছিল ভারতে তৈরি সার্ভিস ড্রেসের একপ্রস্থ কাপড়। ১৫ আগস্টের আগেই খালেদ মোশাররফ এ কাপড়ের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। সেসময় সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মের কাপড় ভারত থেকেই আনা হতো।
ওই প্যাকেট থেকেও অসংখ্য গুজবের জন্ম হয়। আর সেগুলো ডেকে আনে মারাত্মক পরিণতি। গুজবের চরে আটকে যায় বাংলাদেশ। এমনভাবেই আটকায় যে, সেই চর থেকে ছাড়ান পেতে সময় লাগে টানা ২১ বছর।

সহায়ক গ্রন্থ:
বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ (বাংলাদেশ: আ লিগ্যাসি অব ব্লাড-এর ভাষান্তর) অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। অনুবাদক: মোহাম্মদ শাহজাহান। হাক্কানী পাবলিশার্স। সপ্তম মুদ্রণ: মার্চ ২০১২
বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১, ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন এনডিসি, পিএসসি (অব.)। পালক পাবলিশার্স, ২য় প্রকাশ ২০০০।
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ পিএসসি। শিখা প্রকাশনী, ১৯৯৩।

গাজীপুর কথা

    আরো পড়ুন