ছবি- সংগৃহীত
বন্যা দুর্গত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন দেশের সব শ্রেণির মানুষ। তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের জন্য বিতরণ করা খাদ্যের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। একই সঙ্গে এ বিষয়ে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছেন তারা।
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) ‘পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের ক্ষতিকর খাদ্য রেশন বিতরণ’ শিরোনামে ১৬ জন পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যবিদের স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়, অনেক মানুষ বন্যা কবলিত এলাকায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন এবং খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করছেন। তবে এই ইতিবাচক উদ্যোগের মাঝে একটি উদ্বেগের বিষয় রয়েছে। কিছু খাদ্য সামগ্রী যা ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হচ্ছে, তা বন্যা কবলিত এলাকায় বিশেষত শিশুদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আমরা পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লক্ষ্য করেছি যে, পাউডার দুধ, কেমিক্যালযুক্ত বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করা জুস এবং সিরিয়াল ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হচ্ছে।
বিতরণ করা খাদ্যের বিষয়ে বলা হয়, পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের জন্য ফর্মুলা দুধ, পাউডার দুধ, শিল্পজাত পণ্য যেমন জুস, সিরিয়াল, চিনিযুক্ত পণ্য বিতরণের ওপর আইনি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়াও, দুর্যোগের সময় শিশুদের জন্য খাদ্য বিতরণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতে হবে। বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করা কেমিক্যালযুক্ত জুস, পাউডার দুধ এবং সিরিয়াল এই মানগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এ সংক্রান্ত আইন তুলে ধারে বলা হয়, নারী ও শিশু সুরক্ষা আইন, ২০১২-এর ২য় ধারা, উপধারা ১১-এ, দুই বছরের নিচের শিশুদের জন্য বিশেষভাবে স্তন্যদানের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশে স্তন্যদানের বিকল্প (বিএমএস) আইন (ব্রেস্ট-মিল্ক সাবস্টিটিউটস, ইনফ্যান্ট ফুডস, কমার্শিয়ালি ম্যানুফ্যাকচারড কমপ্লিমেন্টারি ফুডস অ্যান্ড দ্য এক্সেসরিজ দেয়ার অফ (রেগুলেশন অফ মার্কেটিং) অ্যাক্ট, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে মা এবং পরিবারকে শিশুদের জন্য সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর উপায়ে খাদ্য সরবরাহের বিষয়ে সঠিক এবং নিরপেক্ষ তথ্য প্রদান করা হয়, যা বাণিজ্যিক প্রভাব মুক্ত। বিএমএস আইনের ভিত্তিতে ২০২০ সালে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং জনস্বাস্থ্য পুষ্টি ইনস্টিটিউট যৌথভাবে একটি নির্দেশিকা তৈরি করে। এতে স্তন্যদানের বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত সম্পূরক খাদ্য এবং সংশ্লিষ্ট সরয়ামের বিপণন নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাউডার দুধ স্তন্যদানের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয় এবং জুস, বাজারে কেনা সিরিয়াল, ফিডিং বোতল বা প্যাসিফায়ার (চুষনি) পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত সম্পূরক খাদ্য এবং সরয়ামের অন্তর্ভুক্ত।
এতে আরও বলা হয়, যদি কোনো ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা বিএমএস আইন লঙ্ঘন করে, যার কারণে কেউ ঋতিগ্রস্ত হয় তবে সেই অবহেলা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর ফলে শাস্তি বা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞা শুধু একটি আইনি বিষয় নয়; শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
এ অবস্থায় পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরেন। এগুলো হলো:
১. স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পুষ্টিবিদ এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী দেখা যায়, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রথম যে জিনিসটির ঘাটতি দেখা দেয় তা হলো নিরাপদ পানীয় জল। অসহায় মানুষ প্রায়ই পাউডার দুধ দূষিত পানির সাথে দূষিত পাত্র বা বোতলে মিশিয়ে তাদের শিশুদের খাওয়ান। বন্যাকবলিত এলাকায় শিশুদের ডায়রিয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। দুর্যোগের এ সময়, ডায়রিয়া শিশুদের গুরুতর অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে, এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
২. ভবিষ্যতের জন্য দুধ সংরক্ষণ করতে এবং খরচ বাঁচাতে, মানুষ প্রায়ই ফর্মুলা দুধের প্রস্তাবিত পরিমাণ ব্যবহার করে না। এর ফলে শিশুকে খাওয়ানোর জন্য পাতলা দুধ তৈরি করে। এই পাতলা দুধ শিশুর অপুষ্টি বাড়ায় এবং প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে নিয়ে যায়।
৩. বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত কেমিক্যালযুক্ত জুস বা সিরিয়াল ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবার যেমন বিস্কুট, কেক, চিপস, ইনস্ট্যান্ট নুডলসে কোনো পুষ্টিগুণ নেই। এই খাবারগুলোতে অতিরিক্ত চিনি, লবণ এবং ক্ষতিকর তেল রয়েছে। এই অতিরিক্ত লবণ, মিষ্টি খাবারগুলো শিশুদের সামান্য পরিমাণ শক্তি প্রদান করে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি যেমন প্রোটিন, ভিটামিন বা খনিজ পদার্থ সরবরাহ করে না। এই খাবারগুলো শুধু পেট ভরায়, কিন্তু কোনো পুষ্টি সরবরাহ করে না এবং শিশুদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো অসংক্রামক রোগের দিকে নিয়ে যায়।
৪. দুর্যোগের সময়, যখন তিন বেলার খাবার নিশ্চিত করা কঠিন হয়, তখন এমন খাবার নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা অল্প পরিমাণে হলেও ন্যূনতম পুষ্টি নিশ্চিভ করে। যা শিশুদের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। ছয় মাসের বেশি বয়সের শিশুদের চিড়া, বাদাম, খেজুর, খিচুড়ি, ডাল বা সুজির মতো খাবার খাওয়ানো বিভিন্ন পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে। এ বিষয়ে, আমরা সরকার অনুমোদিত জরুরি খাদ্য প্যাকেজ সুপারিশ করছি।
৫. ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত যেকোনো দুর্যোগের সময়, বিশেষ করে বন্যার সময়, কারণ এটি নবজাতক এবং ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাদ্য।
এ সময় পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যবিদদের পক্ষ থেকে দুর্যোগকালীন সরকার অনুমোদিত একটি খাদ্য প্যাকেজ তুলে ধরা হয়।