ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ১৮ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

বন্যায় সতর্কতা এবং করণীয়

প্রকাশিত: ১৫:১২, ১৭ জুন ২০২২

আপডেট: ১৫:১৭, ১৭ জুন ২০২২

বন্যায় সতর্কতা এবং করণীয়

বন্যা। ছবি: প্রতীকী

বন্যা নিয়ে প্রায় প্রতিবছরই ভোগান্তির চিত্র চোখে পড়ে। বর্তমানে সিলেটসহ দেশের কয়েকটি জেলায় বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় সেখানকার জনজীবন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বন্যায় মানুষ ও পশুপাখি ভয়াবহ দুর্গতির আশঙ্কায় রয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের রোগবালাই দেখা যায়। এর মধ্যে পানি ও কীটপতঙ্গবাহিত রোগের সংখ্যাই বেশি। বন্যার সময় ময়লা-আবর্জনা, মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র এবং পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা একাকার হয়ে এসব উৎস থেকে জীবাণু বন্যার পানিতে মিশে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে বন্যায় সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার বেড়ে যায়।

বাংলাদেশে কয় রকমের বন্যা হয়?

বাংলাদেশ বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চার ধরনের বন্যা হয়। এগুলো হচ্ছে-

(১) মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে নদ-নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি জনিত বর্ষাকালীন বন্যা।

(২) আকস্মিক (পাহাড়ি ঢল) বন্যা। এই বন্যা বাংলাদেশের উত্তরের কিছু এলাকা, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বাংশের পাহাড়ি অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে হয়ে থাকে। এই বন্যার পানি দ্রুত বাড়ে এবং দ্রুতই আবার কমেও যায়। একই সঙ্গে পানি প্রবাহের গতিবেগ বেশি হয় এবং বন্যা হয় স্বল্প মেয়াদী।

(৩) অপ্রতুল নিষ্কাশন ব্যবস্থা জনিত বন্যা । এ ধরনের বন্যা সাধারণত পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকার কারণে মাঝারি বা ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে পানি জমে কোন কোন এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। এই বন্যার পানি খুব ধীরে কমে এবং বন্যা দীর্ঘ মেয়াদী হয়।

(৪) সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে ঝড়-সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের উচ্চতা জনিত বন্যা।

বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় একাধিক কারণে বন্যা হতে পারে।

বন্যার সময় যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা হয়

• বন্যার সময় পানিবাহিত রোগগুলো বেশি হয়। কারণ, তখন পানির উৎসগুলো সংক্রমিত হয়। নলকূপ ডুবে যায়। বিশুদ্ধ পানির অভাব, দূষিত পানির কারণে এ রকম হয়।
আমাশয়, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস হয় সবচেয়ে বেশি। তাই এই রোগগুলো থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

• কিছু মশাবাহিত রোগ হয়, যেমন—ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু। আটকে থাকা পানিতে এই রোগের জীবাণুগুলো সহজেই বংশবিস্তার করতে পারে। 

• ফাঙ্গাসজনিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়, বিশেষ করে বন্যা-পরবর্তী সময়টাতে। এ সময় নানা রকম চর্মরোগ, চোখের অসুখ হয়। স্ক্যাবিস, আঙুলের মাঝখানে ঘা, টিনিয়া ইনফেকশন এ সময়ে খুব বেশি দেখা যায়। 

• কৃমির প্রকোপ বাড়ে এ সময়ে। 

• আবহাওয়া ও তাপমাত্রার তারতম্যজনিত কারণে নানা রকম ভাইরাসজনিত অসুখ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, গলাব্যথা, সাইনোসাইটিস ইত্যাদি দেখা দেয়। 

বন্যায় কি কি করণীয়

বিশুদ্ধ পানি

বন্যার সময় পানির উৎস দূষিত হয়ে যায়। তাই পানি ভালোমতো ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে পান করাসহ গৃহস্থালির অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করতে হবে। বন্যার পানিতে টিউবওয়েল তলিয়ে গেলে এক কলস পানিতে তিন-চার চা চামচ ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে টিউবওয়েলের ভেতর এই পানি ঢেলে আধা ঘণ্টা রেখে এরপর একটানা আধা ঘণ্টা চেপে পানি বের করে ফেলে দিলে সেই পানি খাওয়ার উপযোগী হতে পারে। ব্লিচিং পাউডার না থাকলে এক ঘণ্টা টিউবওয়েলের পানি চেপে বের করে ফেলতে হবে। তবে নিরাপত্তার জন্য টিউবওয়েলের পানিও ভালোমতো ফুটিয়ে নেয়া উচিত। পানি ছেঁকে জ্বলন্ত চুলায় একটানা ৩০ মিনিট টগবগিয়ে ফুটিয়ে তারপর ঠাণ্ডা করতে হবে।

পানি ফোটানোর ব্যবস্থা না থাকলে প্রতি দেড় লিটার খাওয়ার পানিতে ৭.৫ মিলিগ্রাম হ্যালোজেন ট্যাবলেট (হ্যালো ট্যাব), তিন লিটার পানিতে ১৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট এবং ১০ লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা রেখে দিলে পানি বিশুদ্ধ হয়।

বাসার পানির ট্যাংকের প্রতি এক হাজার লিটার পানিতে ২৫০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার এক ঘণ্টা রাখলে পানি বিশুদ্ধ হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ভাইরাস জীবাণু ধ্বংস হয় না।
 
ডায়রিয়া প্রতিরোধে

বন্যায় প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা ডায়রিয়া। এ জন্য খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। পায়খানা করার পর হাত একইভাবে পরিষ্কার করতে হবে। ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা শুরু হলে পরিমাণমতো খাওয়ার স্যালাইন খেতে হবে। দুই বছরের কম শিশুকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ১০-১২ চা চামচ এবং ২ থেকে ১০ বছরের শিশুকে ২০ থেকে ৪০ চা চামচ খাওয়ার স্যালাইন দিতে হবে। খাওয়ার স্যালাইন বা ওআরএস না থাকলে বিকল্প হিসেবে লবণ-গুড়ের শরবত খাওয়াতে হবে। পাশাপাশি ভাতের মাড়, চিঁড়ার পানি, ডাবের পানি, কিছু পাওয়া না গেলে শুধু নিরাপদ পানি খাওয়ানো যেতে পারে। এ সময় শিশুর পুষ্টিহীনতা রোধে খিচুড়ি খাওয়ানো যেতে পারে। ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুলও খাওয়ানো যেতে পারে। যদি পাতলা পায়খানা ও বমির মাত্রা বেড়ে যায়, তাহলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

খাবার গ্রহণে সতর্কতা

বন্যায় পচা-বাসি খাবার খেতে বাধ্য হয় অসংখ্য মানুষ। ফলে ছড়িয়ে পড়ে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য আন্ত্রিক রোগ। খিচুড়ি খাওয়া এ সময় স্বাস্থ্যোপযোগী। খাবার প্লেট সাবান ও নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। পানি বেশি খরচ হয় বলে অনেকে প্রথমে একবার স্বাভাবিক পানিতে থালাবাসন ধুয়ে তারপর ফুটানো পানিতে ধুয়ে নেন। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এতে থালাবাসনে অনেক ধরনের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে, যা পরে পরিষ্কার পানিতে ধুলেও দূর হতে চায় না। তাই খাবার গ্রহণের আগে থালাবাসন পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।

মলত্যাগে সতর্কতা

বন্যার সময় মলত্যাগে সতর্কতা অবলম্বন খুব জরুরি। যেখানে-সেখানে মলত্যাগ করা উচিত নয়। এতে পেটের পীড়া ও কৃমির সংক্রমণ বেড়ে যায়। সম্ভব হলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে মলত্যাগ করতে হবে এবং মলত্যাগের পরে সাবান বা ছাই দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। মলত্যাগের সময় কখনো খালি পায়ে থাকা চলবে না। কেননা বক্রকৃমির জীবাণু খালি পায়ের পাতার ভেতর দিয়ে শরীরে সংক্রমিত হয়। এ সময় বাসার সবাইকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো উচিত। তবে দুই বছর বয়সের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

দুর্ঘটনা থেকে সাবধান

বন্যার সময় ঘটে আকস্মিক নানা দুর্ঘটনা। সাধারণত বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে যাওয়া, সাপ ও পোকামাকড়ের কামড়ের ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। এ বছরের বন্যায় সাপের কামড়ে মারা গেছে অনেক মানুষ। এ ছাড়া পানির নিচে বহু বৈদ্যুতিক টাওয়ার, খুঁটি, ট্রান্সফরমার লাইনের তার ডুবে থাকে। এসব  বৈদ্যুতিক লাইনের নিচ দিয়ে নৌকা বা ভেলা চালানোর ক্ষেত্রে বা চলাচলের ক্ষেত্রে খুব সতর্ক হতে হবে। বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেলে বা পানিতে পড়ে থাকতে দেখলে তা স্পর্শ না করে বিদ্যুৎকর্মীদের জরুরিভাবে খবর দিতে হবে।

বন্যার আগে যেসব খাবার সংরক্ষণ করবেন

বন্যা চলাকালীন ও তার পরবর্তী সময়ে বিভিন্নরকম সংকট দেখা দিতে পারে। খাদ্য সংকট তার মধ্যে অন্যতম। আমরা সচেতন হলেই এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। চলুন জেনে নেওয়া যাক কোন খাবারগুলো সংরক্ষণ করবেন-

১. চাল, ২. ডাল, ৩. আলু, ৪.লবন, ৫. মুড়ি, ৬. চিড়া, ৭. খই, ৮. নারিকেল, ৯. খেজুর, ১০. বিস্কুট, ১১. গুড়, ১২. বাদাম, ১৩. বিশুদ্ধ পানি, ১৪. স্যালাইন, ১৫. ওষুধ।

বন্যা-পরবর্তী সতকর্তা

বন্যা-পরবর্তী সময়ে মানুষ (দুই বছরের নিচের শিশু ব্যতীত) ও গবাদিপশুকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। শামুক মানুষ ও পশুপাখির বিভিন্ন পরজীবীর বা কৃমির মধ্যবর্তী পোষক হিসেবে কাজ করে। এসব শামুক হাঁসের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে অথবা এগুলোকে নিধন করতে হবে। এ ছাড়া কৃমিনাশক ওষুধ নিয়মিতভাবে চার থেকে ছয় মাস অন্তর খাওয়াতে হবে।

বন্যার সময় সাপ ও ইঁদুর তাদের আবাস হারিয়ে শুকনো স্থানে মানুষ ও গবাদি পশুপাখির সঙ্গে অবস্থান নেয়। এ জন্য সাপ ও ইঁদুরে কাটার পরিমাণ বেড়ে যায়। বিষহীন সাপে কাটলে ভয়ের কিছু নেই। তবে বিষধর সাপে কাটলে সাপে কাটা স্থানের সামনে মোটা কাপড় বা গামছা বা রশি দিয়ে দিয়ে গিঁট দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে অ্যান্টিভেনম এবং টিটেনাস প্রতিষেধক দিতে হবে। ইঁদুরে কাটলেও অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।