দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর জন্য নাটোরের রাজবাড়ি ‘উত্তরা গণভবন’ এর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। সেই সঙ্গে রয়েছে নজরকাড়া সংগ্রহশালা। তাই প্রতিবছরই এই রাজবাড়ি দেখতে আসে অসংখ্য দর্শনার্থীরা।
বিশাল এই রাজবাড়ি জুড়ে আছে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য গাছ। আর গাছে গাছে আছে হাজারো পাখির কূজন। করোনাকালীন সময়ে দর্শনার্থীদের পরিদর্শন বন্ধ থাকায় লোক চক্ষুর আড়ালে বেড়েছে পাখির আবাস। গণভবনেই দেখা মিলেছে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে থাকা সাপপাখি বা গয়ার। নাটোরের উত্তরা গণভবন এখন পাখির অভয়াশ্রম।
এই উত্তরা গণভবনে পাখির রাজত্বে দেখা মেলে সাদা-কালো হাঁড়িচাচা পাখির। সারাদিন হ্রদে চলে অজস্র ছোট পানকৌড়ির খাবার অন্বেষণ। গাছে গাছে চড়ে বেড়ায় তিন প্রজাতির কাঠঠোকরা। ঝোপ-জঙ্গলে দেখা মেলে বড় কুবোর। সবজি বাগানে বাস করে ফিস ঈগল। সময়ে সময়ে দেখা দেয় তিশাবাজ। গাছে গাছে বাস করে পাঁতি সরালি। খাবার সন্ধানে খাল-বিলের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় ওরা।
অনেকে দেশীয় এই পাখিকে পরিযায়ী বলে ভুল করেন। আর সন্ধ্যায় দেখা মেলে খুড়ুলে পেঁচার। গাছে গাছে বেঁধে রাখা কলসীগুলোতে দিনের বেলায় ওদের বাস। পেঁচারা সংখ্যায় ক্রমশ বাড়ছে। তাছাড়াও ময়না, ঘুঘু, ডাহুক, কয়েক প্রজাতির মাছরাঙা, বুলবুলি, শালিক চড়ুই, ফিঙ্গে তো আছেই।
গণভবনে বাসকারী পাখিদের সুরক্ষা দিতে এবং পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ১৫ জুন প্রাণিসম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ার উত্তরা গণভবনকে পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে উদ্বোধন করেন। জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় উদ্বোধনকৃত এই অভয়াশ্রমে পাখিদের উপযোগী অসংখ্য গাছ রোপণ করা হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে পাখির আবাস।
এখানে শত বছর ধরে সারি করে দাঁড়িয়ে থাকা পাম গাছগুলোতে হাজারো দেশী টিয়া পাখির আবাস। সকাল হতেই ঝাঁক ধরে বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে। তবে ঐ সময়ে একটি মাত্র টিয়া পাখির কান্না শুনতে পাওয়া যায়। পাখি প্রেমিকরা চিড়িয়াখানাতে আটকে থাকা দেশীয় এই টিয়াকে মুক্ত করে দেওয়ার দাবী জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের প্রতি।
অরিয়েন্টাল ডার্টার বা সাপপাখি বা গয়ার প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে বিলুপ্তপ্রায় এই পাখির সংখ্যা মাত্র চার থেকে পাঁচ হাজার। এ কারণে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এর প্রায়-বিপদগ্রস্তের তালিকায় এ পাখিকে রাখা হয়েছে। উপমহাদেশের ভারতসহ কয়েকটি দেশে এর দেখা মেলে। সম্প্রতি এই পাখির দেখা মিলেছে নাটোরের উত্তরা গণভবনে। মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়ানো পর্যটক এই পাখির যাতায়াতের বিরতিস্থল আমাদের উত্তরা গণভবন।
উত্তরা গণভবনে পাখিদের অবস্থান নিয়ে কাজ করছেন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার মূর্তজা সারওয়ার। পাখিপ্রেমিক সারওয়ার বলেন, ‘২০২০ সালের মে মাস থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি অবধি বেশ কয়েকবার বার্ডিং করেছি উত্তরা গণভবনে। দেখেছি, রাজপ্রাসাদ বেষ্টিত দিঘীর চারপাশের পুরানো আম বাগানে গাছের ডালে ডালে উড়ে বেড়ায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। জলাধারে মাছ খেতে আসে কয়েক প্রজাতির বক। আপন মনে ঘুরে বেড়ায় ডাহুক। পানকৌড়ি তো আছেই, বিলুপ্তপ্রায় সাপপাখিকেও দেখা গেছে একদিন। হাজার হাজার টিয়া উড়ে যাওয়ার অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়েছে অনেকবার। পুরনো ঐ বাগানে খুব ভালো প্রজনন হয়েছে খুঁড়ুলে পেঁচাদের।
করোনাকালীন সময়ে বিধিনিষেধে উত্তরা গণভবনে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ থাকায় পাখিদের বিচরণ হয়েছে নির্বিঘ্নে। গণভবনে ৪৩ রকমের পাখি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।
পক্ষিকূলের আশ্রয় ও খাদ্য নিশ্চিতকরণ প্রকল্পের সমন্বয়কারী যশোধন প্রামানিক বলেন, ‘উত্তরা গণভবন এখন পাখিদের অভয়াশ্রম। পাখিদের সুরক্ষা দিতে আমবাগান ইজারা দেওয়া বন্ধ করাসহ গণভবন জুড়ে দেশীয় ফলের গাছ বৃদ্ধি করা উচিৎ।’
গাজীপুর কথা