ঢাকা,  শুক্রবার  ১৯ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

একজন ক্ষণজন্মা কিংবদন্তির কথা

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ১৯ আগস্ট ২০২২

একজন ক্ষণজন্মা কিংবদন্তির কথা

একজন ক্ষণজন্মা কিংবদন্তির কথা

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারার চোখে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে, একাত্তরের পুরো সময়জুড়ে নিজের হাতে প্রাণ নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন রক্তাক্ত বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। পাকিস্তানি হায়েনাদের চালানো সভ্যতার সবচেয়ে নৃশংস ও বর্বর হামলার ওপর ভিত্তি করে আদিকালের একটি ক্যামেরা নিয়ে নির্মাণ করেছেন ডকুমেন্টারি ‘স্টপ জেনোসাইড’। যিনি পরিচিত ‘বাংলাদেশের সিনেমার জনক’ হিসেবে। যার কথা বলছি তিনি অন্য কেউ নন  চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, এবং গল্পকার জহির রায়হান।

তিনি ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার সম্পূর্ণ নাম ছিল মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। তিনি প্রাথমিক শিক্ষার পর্ব শেষ করেন কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট এবং পরবর্তীতে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় বাবা-মার সাথে কলকাতা ছেড়ে বাংলাদেশে নিজ গ্রামে চলে আসেন তিনি। ১৯৪৯ সালে সাহিত্য ম্যাগাজিনে তার প্রথম কবিতা ‘ওদের জানিয়ে দাও’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে ফেনীর আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে এখান থেকে আইএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু সেখানে পড়ালেখা চালিয়ে না গিয়ে চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে তিনি বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন।

জহির রায়হান মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৯৫৭ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ চলচ্চিত্র দিয়ে পা রাখেন সিনেমা জগতে। তারপর এক যুগ ধরে ‘সোনার কাজল (১৯৬২), ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৯৩), ‘সঙ্গম’ (উর্দু: ১৯৬৪), ‘বাহানা’ (১৯৬৫), ‘বেহুলা’ (১৯৬৬), ‘আনোয়ারা’ (১৯৯৬৭), আর ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)’র মতো অসাধারণ সব চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন।

জহির রায়হান তিনি শুধু প্রতিভার স্বাক্ষর চলচ্চিত্রে রাখেননি, রেখেছেন সাহিত্যেও। স্কুল জীবন থেকেই লিখতে ভালোবাসতেন। তার লেখা গল্প, কবিতা ছাপা হতো পত্রিকায়। তার প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ প্রথমে সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় জহির রায়হানের জীবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’। সাহিত্যিক হিসেবে তার একমাত্র পুরস্কারপ্রাপ্তিও এ উপন্যাসের কল্যাণে। বাংলাদেশের আবহমান গ্রামীণ জীবন নিয়ে লেখা এ উপন্যাসটিকে ২০০৫ সালে সুচন্দা চলচ্চিত্ররূপ দেন। জহির রায়হানের পরবর্তী উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’। এ উপন্যাসটি ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে রচিত। ছোট গল্পকার হিসেবে অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন জহির রায়হান। নিজেই ‘জহির রায়হানের একশ’ গল্প নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলেন। যদিও সেটি আর শেষ করতে পারেনি তিনি।

কৈশোরকাল থেকেই সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। কমরেড মণি সিংহ তার নাম পাল্টে জহির রায়হান রাখেন। ভাষা আন্দোলনের সময় প্রথম যে দশজনকে গ্রেফতার করা হয়, জহির রায়হান ছিলেন তাদের মাঝে অন্যতম। ভাষা আন্দোলনের ঝড় সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া জহিরকে পাল্টে দেয়। তার পরবর্তী সৃষ্টিতে তাই বারংবার ভাষা আন্দোলন ফিরে এসেছে। ড. হুমায়ুন আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘জহির রায়হান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যার উদ্ভবের পেছনে আছে ভাষা আন্দোলন। যদি বায়ান্ন’র একুশ না ঘটতো তবে জহির রায়হান হয়তো কথাশিল্পী হতেন না।’

ব্যক্তিগত জীবনে জহির রায়হান দুবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬১ সালে তিনি সুমিতা দেবীকে বিয়ে করেন এবং তার সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর ১৯৬৮ সালে জহির সুচন্দাকে বিয়ে করেন। তার দুই স্ত্রীই ছিলেন নামকরা অভিনেত্রী। সুমিতা এবং জহিরের সংসারে দুই পুত্রসন্তানের জন্ম হয়, যাদের নাম বিপুল রায়হান এবং অনল রায়হান। সুচন্দা এবং জহির রায়হানের একটিই পুত্র, তপু রায়হান।

জহির রায়হানের মৃত্যু কিংবা অন্তর্ধান একটি রহস্যজনক ঘটনা। বলা হয়, একটি সংঘবদ্ধ চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অকালে প্রাণ হারান এ সম্ভাবনাময় সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের নিধন করে একটি পঙ্গু স্বাধীন রাষ্ট্র ফেলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৪ ডিসেম্বর গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনির চৌধুরী, আনোয়ার পাশা প্রমুখসহ আরো ১১১০ জন বুদ্ধিজীবীর সাথে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শহিদুল্লাহ কায়সারকে। বাংলা সাহিত্যের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র শহিদুল্লাহ কায়সার ছিলেন জহির রায়হানের বড় ভাই।

ভাই শহিদুল্লাহ কায়সার মারা গেছেন না তাকে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না পরিবারে কেউ। স্বাধীনতার একেবারে পূর্ব মুহূর্তে এত বড় শোক সামলে উঠতে পারেননি তারা। তাই যখন জহির রায়হানের কাছে একটি ফোনকল আসে যে মিরপুরেরই কোনো একটি জায়গায় আটকে রাখা হয়েছে শহিদুল্লাহকে, তখন ভাই বেঁচে আছে এ আশাতেই ছুটে চলে যান জহির রায়হান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও সম্পূর্ণ দেশ কিন্তু তখনো শত্রুমুক্ত হয়নি। বিশেষ করে মিরপুরের এলাকাগুলো বিহারি অধ্যুষিত হওয়ায় স্থানীয় বিহারি এবং মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের সহায়তা করা বিহারিদের মধ্যে এক ধরনের আঁতাত হয় ঐ এলাকাটিতে। ধারণা করা হয় তার পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ষড়যন্ত্রের শিকার হন জহির রায়হান।

‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়া জহির রায়হানকে নিয়ে একটি অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। একই বছর জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ এর ১৩ আগস্ট সংখ্যার জন্য একটি কভার স্টোরি লেখেন, যার শিরোনাম ছিল ‘পিতার অস্থির সন্ধানে’। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনল রায়হান খুঁজে বের করেন একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে। এই প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বাংলাদেশ আর্মির একজন সাবেক সৈনিক আমির হোসেইন। আমিরের ভাষ্যমতে, ক্যাপ্টেন হেলাল মুর্শিদ খানের নেতৃত্বে এক প্লাটুন সামরিক সৈন্যের সাথে মিরপুরের এক বাড়িতে যান জহির রায়হান। ভাইয়ের খোঁজে উপস্থিত একমাত্র পারিবারিক সদস্য হিসেবে সাথে রাখা হয় তাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাড়িটিতে তারা পৌঁছানো মাত্র চারদিক থেকে গুলি বর্ষণ করে বিহারি মুসলিম শরণার্থীরা। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে সব অস্ত্র তখনো সংগ্রহ করতে পারেনি সদ্য স্বাধীন দেশটির সামরিক বাহিনী। কাজেই বিহারিদের কাছে লুণ্ঠিত বা অবৈধ অস্ত্রের কোনো অভাব ছিল না। আমির দেখেন কয়েক রাউন্ড গুলি ঝাঁঝরা করে দিয়ে যায় জহির রায়হানের শরীর। জুলফিকার আলী মানিকের রিপোর্টেও একই কথা বলা হয়।

ঘটনাস্থলে নিহত হন প্রায় ৪২ জন সামরিক সদস্য। বাকিরা মারাত্মক আহত অবস্থায় ফিরে আসেন। লোকবল কম থাকায় পাল্টা কোনো অপারেশনে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না বাংলাদেশি সামরিক সেনাদের পক্ষে। বিনা প্রস্তুতিতে এমন হামলায় কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসা সৈনিকরা পরদিন পূর্ণ প্রস্তুতিতে আবার রেকি করেন মিরপুরের সেই বাড়িটি। কিন্তু সেখানে গিয়ে ৩-৪ জন সৈনিকের মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাননি তারা। জহির রায়হানের কোনো চিহ্নও সেখানে ছিল না। তাই জহির রায়হান মারা গেছেন, না তাকে কোথাও আটকে রাখা হয়েছে, তা নিয়ে বিস্তর খোঁজাখুঁজি চলেছে দীর্ঘ ২৮ বছর যাবত। পরবর্তীতে অনল রায়হানের এই প্রতিবেদনে সবাই বুঝতে পারেন যে, জহির রায়হান আর বেঁচে নেই। তারপরও প্রতি বছর ৩০ জানুয়ারি দিনটিকে জহির রায়হানের প্রয়াণ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

জহির রায়হান যখন হারিয়ে যান কিংবা মারা যান তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৬ বছর। এই ৩৬ বছরের ক্ষণজন্মা মানুষটি বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে রেখেছেন অসামান্য অবদান। আজ এই প্রতিভাধর বাংলা কিংবদন্তির প্রয়াণ দিবস। প্রয়াণ দিবসে জহির রায়হানকে ডেইলি বাংলাদেশকে পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।