ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ২৮ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

পরিচিত জনের পরিচিতি যেখানে, আছে লুকোনো কিছু গল্প-ভালোবাসা

প্রকাশিত: ২০:২০, ১৮ মার্চ ২০২৩

পরিচিত জনের পরিচিতি যেখানে, আছে লুকোনো কিছু গল্প-ভালোবাসা

ছবি: সংগৃহীত

মুক্তবুদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় অনন্য এক জগৎ। বলা হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিও। আছে সংস্কৃতির রাজধানীর তকমাও। সংস্কৃতি অঙ্গনে অবদান রেখে চলেছেন সেই বিদ্যাপীঠের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন অনেকেই। কুড়চ্ছেন প্রশংসা। হচ্ছেন দর্শকনন্দিত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। যেখানে দেশের অনেক পরিচিত জনের পরিচিতি লুকিয়ে আছে। আছে লুকোনো কিছু স্মৃতিকথা।

হুমায়ূন ফরীদি, ফারুক আহমেদ, শুভাশীষ ভৌমিক, শহিদুজ্জামান সেলিম, মাজনুন মিজান, সজল নূর, সুমাইয়া শিমু, জাকিয়া বারী মম, বিদ্যা সিনহা মিমদের স্মৃতিধন্য হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাস। একই সঙ্গে মীম মানতাশা, ফকির সাহেবের মতো তরুণরাও উঠে আসছেন। মাতাচ্ছেন সংস্কৃতির মঞ্চ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা তারকাখ্যাতি পেয়েছেন তাদের মধ্যে হুমায়ূন ফরীদি অগ্রগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই শিক্ষার্থী অর্থনীতি বিভাগের পঞ্চম ব্যাচে ভর্তি হয়েছিলেন। থাকতেন আল-বেরুনী হলে। জাহাঙ্গীরনগরে কাটানো অনেক অমলিন স্মৃতির কথা বিভিন্ন সময়ে বলে গেছেন তিনি।

‘ঈদুল আজহার সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনী হলের বেশিরভাগ ছাত্ররা বাড়িতে চলে গেছে। তখন হলে ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন। যাদের মধ্যে ছিলেন হুমায়ুন ফরীদিও। তারা সদলবলে গেলেন প্রয়াত অধ্যাপক কলিমুল্লাহর বাসায়। হুমায়ুন ফরীদি গিয়ে বললেন, ‘স্যার! আমরা কয়েকজন ছাত্র হলে আছি, কুরবানির ঈদ স্যার, আমাদের একটা গরুর ব্যবস্থা করে দেন কুরবানি উপলক্ষে। আমরা হলে ছাত্ররা খাব।’

অধ্যাপক কলিমুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কয়জন?’
‘আমরা ২০-২২ জনের মত আছি স্যার, বললেন ফরীদি।

‘তাহলে তোমাদের গরু লাগবে না, এক কাজ কর, আমি খাসির ব্যবস্থা করছি তোমাদের জন্য।’

এই যাত্রায় একরকম হতাশ হয়েই ঐ শিক্ষকের বাসা থেকে বের হচ্ছিল তারা। তখনই শিক্ষকের বাসার বাইরে কুরবানির জন্য কিনে এনে রাখা কালো গরুটা নজরে পড়ল। চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল ফরীদির সঙ্গে বাকি সবার। সেদিন রাতেই গরু চুরি করে নিয়ে আসা হলো। সকালে সাভার থেকে কসাই আসলেন। দেড় মণের মত মাংস হলো। ফরীদি কসাইকে বললেন, ১৫ কেজির মতো রান্না করতে। আর বাকিটা রেখে দিতে হবে।

এদিকে সকাল বেলায় নিজের গরু না পেয়ে অধ্যাপক কলিমুল্লাহর চক্ষু চড়কগাছ। উপায় না দেখে সকালেই নয়ারহাট থেকে গরু কিনে আনলেন। আর হলের ছেলেদের কাছে খবর পাঠালেন, ‘তোমরা আমার বাসায় এসে সেমাই খেয়ে যেও।’

সেমাই খেতে যাওয়া বালকেরা খালি হাতে গেল না। বেঁচে যাওয়া গরুর মাংস সব নিয়ে গেল স্যারের বাসায়। স্যার বললেন, ‘এগুলা কী?’

ফরীদি মুচকি হেসে বললেন, ‘আমরা স্যার একটা গরু কিনেছিলাম, আমাদের খাওয়া শেষ, তাই ভাবলাম বাকিটা আপনার জন্য নিয়ে আসি।’

স্যার সব বুঝে গম্ভীর মুখে বললেন- ‘হ্যাঁ হ্যাঁ! বুঝলাম! রাখো এই মাংস, আর খেতে বসো।’

অভিনয় জগতে আরেক উজ্জ্বল নাম ফারুক আহমেদ। ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৮ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন ফারুক আহমেদ। থাকতেন মীর মশাররফ হোসেন হলে। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নাটক রচনা ও পরিচালনাও করেন। জাহাঙ্গীরনগর নিয়ে ফারুক আহমেদের একটি উক্তি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। 

তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনের এই পরিণত বয়সে কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে তুমি কি চাও? আমি বলব, আমি জাহাঙ্গীরনগরের ৬ বছরে ফিরে যেতে চাই। কেউ যদি বলে তুমি কি প্রধানমন্ত্রী হতে চাও, নাকি ৬ বছর চাও? আমি তবুও বলব, ঐ ৬ বছর চাই।’

শুভাশীষ ভৌমিকের মতো জনপ্রিয় অভিনেতাও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। ১৯৭৮ সালে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ভর্তির পর থেকে থিয়েটার ও মঞ্চ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হন। এখন পর্যন্ত নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন অভিনয়ে। ‘কীর্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘হাত হদাই’, ‘ধূর্ত ওই’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘আওয়ার কান্ট্রিজ গুড’-এর মতো দর্শন নন্দিত নাটকে অভিনয় করেছেন। হানিফ সংকেতের উপস্থাপনা ও পরিচালনায় জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে কাশেম টিভির রিপোর্টার হিসেবে তার জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া।

একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম বেড়ে উঠেছেন জাহাঙ্গীরনগরের সবুজ প্রাঙ্গণে। পড়েছেন অর্থনীতি বিভাগে নবম ব্যাচে। থাকতেন মীর মশাররফ হোসেন হলে। সেলিম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরে ১৯৮০ সালে ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন। এর প্রায় ৯ বছর পরে বিটিভির আলোচিত ধারাবাহিক ‘জোনাকি জ্বলে’র মধ্য দিয়ে তার ছোটপর্দায় অভিষেক ঘটে।

এছাড়াও অভিনয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ২৪তম ব্যাচের মাজনুন মিজান, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইবিএ) ২৬তম ব্যাচের আব্দুন নূর সজল। পাশাপাশি নারীদের মধ্যে রয়েছেন জনপ্রিয় অভিনেতা সুমাইয়া শিমু, জাকিয়া বারী মম, বিদ্যা সিনহা মীম। এদের মধ্যে শিমু সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ২৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। আর মম নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের পড়েছেন ৩৪ তম ব্যাচ এবং বিদ্যা সিনহা মীম ছিলেন একই বিভাগের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

আর তরুণদের মধ্যে লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার বিজয়ী মীম মানতাশা ছিলেন চারুকলা বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। বর্তমানে ইউটিউবে ব্যাপক দর্শকপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফকির সাহেব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। শহীদ রফিক-জব্বার হলে এখনও পাওয়া যায় তাকে। মোবাইলে ধারণ করা তার গান ইউটিউবে শুনছে লাখ লাখ মানুষ। হচ্ছেন ভাইরাল।

এতো এতো তারকা তৈরির পেছনে যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিমনা পরিবেশের ভূমিকা রয়েছে তা স্বীকার করতেই হবে। গ্রিসের সঙ্গে উঁচু-নিচু মৃত্তিকার জাহাঙ্গীরনগরের সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্যতা করে তৈরি করা হয়েছে মুক্তমঞ্চ। যার নাম হয়েছে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের নামে। গ্রিক এরিনার ওপেন এয়ার স্টেজের (মুক্তমঞ্চ) আদলে ভারতীয় উপমহাদেশে এ ধরণের মঞ্চ নির্মাণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রথম।