ঢাকা,  মঙ্গলবার  ২৩ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

হতাশার মোড়: হাজারো প্রেম-বিচ্ছেদের সাক্ষী

প্রকাশিত: ১৮:০৮, ২ অক্টোবর ২০২২

হতাশার মোড়: হাজারো প্রেম-বিচ্ছেদের সাক্ষী

বশেমুরবিপ্রবির হতাশার মোড়।

ভালোবাসা– প্রেম প্রতিটি মানুষের জীবনের বিশেষ অংশ। কেউবা ভালোবেসে ভালো থাকে, মেলে আত্মার প্রশান্তি। আবার কেউবা তলিয়ে যায় হতাশার অতল গহ্বরে। আর সেই ভালোবাসা বা বিচ্ছেদের গল্প যদি কোনো স্থানকে কেন্দ্র করে হয়, তবে সে জায়গাটি স্মরণীয় হয়ে থাকে মনে। 

এমনই এক জায়গার দেখা মিলবে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি)। জায়গাটির নাম হতাশার মোড়। যেখানে মিশে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো প্রেমিক যুগলের সুখ-দুখের নানা কাহিনী। চির ভাস্বর হয়ে আছে অগণিত প্রেম–বিচ্ছেদের গল্প।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবনের মধ্যবর্তী সড়ক পাড় হলেই দেখা মিলবে বশেমুরবিপ্রবির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। এরপরে ‘ল’ চত্বর। একটু সামনে আগালেই দেখা যাবে ঘন ঝাউবনে ঘেরা তিন রাস্তার মোড়। একটি রাস্তা একাডেমিক ভবনে, একটি ছেলেদের হলে ও আরেকটি রাস্তা চলে গেছে ছাত্রী হলের দিকে। ছাত্রী হল সংলগ্ন বাহারি ফুল আর সবুজে ঘেরা ছায়া সন্নিবেশিত এই স্থানটি হতাশার মোড় নামে পরিচিত। এই রাস্তার কোল ঘেঁষে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে ছাত্রীদের বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ও শেখ রেহানা হল।

হতাশার মোড়ে দিনের অধিকাংশ সময়ে ক্যাম্পাসের প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমের গল্পে রোমান্টিক আমেজ তৈরি হয়। ভোরের শিশির ভেজা ঘাস মাড়িয়ে, কাঠফাটা রোদেলা দুপুরে আর অন্ধকার মেশানো ঘন রাতেও এখানে দেখা মিলবে কতশত প্রেমিক যুগল। কখনও কোনো প্রেমিক ফুল হাতে, কখনো মুখরোচক খাবার নিয়ে, আবার কখনও বৃষ্টিতে ছাতা হাতে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয় মানুষটির অপেক্ষায়। প্রিয়জনকে নিয়ে হতাশার মোড়ে কাটে ভালোবাসার কিছু মধুময় সময়। পিচঢালা পথ ধরে হাঁটা যায় বাস্তবের অবাস্তব এক কল্পনার পথে। চারপাশের পাখির কুঞ্চন, বাহারি ফুলের সুবাস আর সবুজে ঢাকা গাছের মিশ্রণ সবকিছু মিলিয়ে জায়গাটিতে গ্রাম বাংলার অপরূপ ছবির দেখা মিলে।

আবার এখানেই সন্ধ্যার ফ্যাকাসে অন্ধকার আসতে না আসতে   সারাদিনের ক্লাস– পরীক্ষার ব্যস্ততা সেরে আড্ডা জমায় আড্ডাবাজ বন্ধুরা। পাশে থাকা ছাত্রীদের খেলার মাঠে তারা দলবেঁধে হাসি– গানে মেতে রাতের আঁধার গায়ে মেখে ফিরে। আবার বিকেল হলে এখানে বেশকিছু ফুডকার্ট আর ভ্রাম্যমাণ দোকানের দেখা মিলে। এসব দোকান যেন আড্ডার রসদ যোগায়।

 

বশেমুরবিপ্রবির হতাশার মোড়। ছবি: ডেইলি বাংলাদেশ

বশেমুরবিপ্রবির হতাশার মোড়। 

এতসবের মধ্যেও হতাশা মোড়ে হতাশার ছাপ থেকেই যায়। হাজারো প্রেম- বন্ধুত্বের মধ্যেও এই মোড়ে টানতে কতশত সম্পর্কের ইতি। প্রিয়জনের সঙ্গে কথা কাটাকাটি, মনোমালিন্য কিংবা ঝগড়াঝাঁটি হতাশার মোড়ের নিত্যকার ঘটনা। এসবকে কেন্দ্র করে আবার এখানেই প্রেমের ভাঙনের কান্নায় থমথমে হয়ে যায় চারপাশ। পাশের ছাত্রী হলে প্রিয়তমার সঙ্গে কাটানো শেষ স্মৃতির সাক্ষী হয় এই মোড়। এসবের কারণেই জায়গাটি বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের কাছে হতাশার মোড় নামে পরিচিতি। 

কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুকান্ত বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি জানান, আমাদের ক্যাম্পাসে হতাশার মোড়ের মতো এমনি অনেক স্থান আছে যেগুলো শিক্ষার্থীরা মজাচ্ছলে নামকরণ করেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা-কলমে প্রাতিষ্ঠানিক এর কোনো রূপ নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকাকালীন জায়গাগুলেতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রেমিক যুগলদের পাশাপাশি আড্ডা চলে। 
কথা হয় আড্ডারত কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তারা জানান,  বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই জায়গাটির নাম হতাশার মোড় শুনে এসেছেন। অদ্ভুত এই নামটি বারবার শুনতে শুনতে এখন আর অদ্ভুত মনে হয় না। বরং আড্ডার জন্য পছন্দের জায়গা এটি। বিকেলে এখানে বসলে মনের প্রশান্তি মেলে। দিনভর ক্লাসের একঘেয়েমি শেষে নির্মল বাতাসে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস মেলে। তাইত ছুটির দিনেও এর স্নিগ্ধতার টানে প্রায় প্রতিদিনই ছুটে আসি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম   জানান, হতাশার মোড়ে প্রিয়জনের সঙ্গে গল্প করে সময় পার করা সত্যিই মধুর অনুভূতি। বিকেলের বাতাস ক্লান্ত শরীরে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। ছোট ছোট গ্রুপে সব বন্ধুরা যখন আড্ডা দেয় যা দেখতেও ভালো লাগে। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যখন চলে যাবো তখন এই নিষিদ্ধ চত্বরের আড্ডা খুব মিস করব।

হতাশার মোড়ে ভালোবাসার গল্পের সঙ্গে বিচ্ছেদের গল্পও কম নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, হতাশার মোড় নামটা শুনলে মনের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। প্রিয় মানুষটির সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা এখানেই হয়েছিল। বেশ কয়েক বছর প্রেম শেষে আমাদের সম্পর্কের ইতিও ঠিক এখানেই ঘটেছিল। পরিবারের চাপে সত্যি সেদিন সে আমাকে কাঁদিয়ে চিরতরে চলে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কেউ চলে গেলেও অনেক শিক্ষার্থী এই হতাশার মোড়ের টানে হলেও ফিরে আসবে বশেমুরবিপ্রবির বুকে। ফিরে আসবে তাদের কতশত স্বপ্নজালে বোনা স্মৃতি আর স্বপ্ন ভাঙ্গার সাক্ষী এই রাস্তায়। তাইতো হতাশার মোড় শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা নয়, এ যেন হাজারো প্রেমে-বিচ্ছেদের জীবন্ত সাক্ষী।