আবদুল্লাহ আল মুনায়েম
আবদুল্লাহ আল মুনায়েম। প্রায় এক যুগ আগে ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার মিদ্দার হাটের কামাল উদ্দিন ও বিবি কুলসুমের সংসারে তার জন্ম। সংসারে প্রথম সন্তান জন্মের খবরে দম্পতিটি খুশি হলেও সেই খুশি ম্লান হয়ে গিয়েছিল জন্মের পর সন্তানের দুটি হাত নেই দেখে।
প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মের পর প্রতিবেশীদের নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে কামাল আর কুলসুমকে। অভাবের সংসারে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবসময়ই দুশ্চিন্তায় থাকতেন আবদুল্লাহ আল মুনায়েমের মা-বাবা। তবে ছোটবেলা থেকেই কুলসুমের সংকল্প ছিল তার ছেলে যেন কারো ওপর নির্ভরশীল না হয়। এ জন্য আবদুল্লাহকে পা দিয়ে সব কাজ করা শিখিয়েছেন তিনি। পা দিয়েই লিখতে পারে মুনায়েম। শুধু লেখা নয়, পায়ের আঙুলের ফাঁকে রং পেনসিল ধরে সে এখন ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলে চমৎকারসব চিত্রকর্ম।
গত ঈদুল ফিতরে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের ঈদের শুভেচ্ছা কার্ডে স্থান পেয়েছে মুনায়েমের আঁকা ছবি। বঙ্গবন্ধু ও গ্রামবাংলা নিয়ে আঁকা ছবিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরেও আসে। এরপর ফেনী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে মুনায়েমের পরিবারের অসচ্ছলতার বিষয়টি জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাকে উপহারস্বরূপ নগদ এক লাখ টাকা দেয়া হয়। এছাড়া আড়াই শতাংশ জমির ওপর তাদের একটি আধাপাকা টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) দাগনভূঞা পৌরসভার উদরাজপুর এলাকায় ওই বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তবে মুনায়েমের এ সাফল্য দেখতে পারেননি তার বাবা কামাল উদ্দিন। তিন বছর আগে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ওমানে পাড়ি জমিয়েছিলেন কামাল। তবে ভাগ্য মুখ তুলে তাকায়নি। বছর দুয়েক আগে ওমানেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। স্বামীকে হারানোর পর কুলসুমের কাঁধে চাপে পুরো সংসারের দায়িত্ব। মুনায়েম বর্তমানে দাগনভূঞা একাডেমিতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। তার ছোট ভাই একই বিদ্যালয়ে শিশুশ্রেণিতে পড়াশোনা করে।
দুই হাত না থাকলেও থেমে থাকেনি মুনায়েম। পা দিয়ে লেখা ও ছবি আঁকতে পারে সে। বর্তমানে দুই ছেলেকে নিয়ে কুলসুম দাগনভূঞা শহরে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। কুলসুম বলেন, ‘এতদিন আমার ভাই ও অন্যান্য স্বজন ছেলেদের পড়াশোনার খরচ দিতেন। অনেক কষ্টে ছেলেদের পড়াশোনা করাচ্ছি। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাকে নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তবে আমি ছেলেকে সব কাজ করতে শিখিয়েছি। শতকষ্ট হলেও ওর পড়াশোনা বন্ধ করিনি। এখন এই ছেলেই আমাদের গর্বিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ।’
এদিকে মঙ্গলবার দাগনভূঞা পৌরসভার উদরাজপুর এলাকায় ওই বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর কাজের উদ্বোধন করেন ফেনীর জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান। অনুষ্ঠানে আবদুল্লাহর পরিবারের জন্য কেনা জমির মূল্য বাবদ জমির মালিককে ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার একটি চেক হস্তান্তর করা হয়।
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান বলেন, জন্মগতভাবে শিশুটির দুই হাত নেই। তবুও সে নিজেকে একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলছে। প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সে পা দিয়ে ছবি এঁকে উপজেলা ও জেলায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। তার আঁকা ছবি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তার নির্দেশেই জমিসহ পাকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে।
এর আগে আবদুল্লাহ আল মুনায়েমের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে সালেহ উদ্দিন চৌধুরী ও হোসনে আরা চৌধুরী ফাউন্ডেশন। যতদিন সে পড়াশোনা করবে, ততদিন লেখাপড়ার খরচ দেবে ওই প্রতিষ্ঠান।
মুনায়েমের ছবি আঁকা শেখার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক গিয়াস উদ্দিন। তিনি বিনামূল্যে আবদুল্লাহকে ছবি আঁকা শেখান। গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘কোনো কিছুই তাকে থামাতে পারেনি। সে আসলেই অদম্য। এ জন্য আমি তার কাছ থেকে টাকা নিই না। তার ছবিতে গ্রামবাংলা, প্রকৃতি ও আশপাশের মানুষের গল্প ফুটে ওঠে। রাষ্ট্রও মুনায়েমের প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা সবার জন্যই আনন্দের খবর।’
প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি পেয়ে দারুণ খুশি আবদুল্লাহ আল মুনায়েম। নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছে সে। বলে, ‘আপাতত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। পড়াশোনা শেষে যা-ই করি-না কেন, ভালো মানুষ হতে চাই। আর ছবি আঁকতে আমার ভালো লাগে। সেটিও চালিয়ে যাব।’