ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ২৫ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

সবুজের স্বপ্নে বাঁচেন গাছপাগল মাওলা, গড়েছেন অনন্য দৃষ্টান্ত

প্রকাশিত: ১৭:২৯, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২

সবুজের স্বপ্নে বাঁচেন গাছপাগল মাওলা, গড়েছেন অনন্য দৃষ্টান্ত

মো. মাওলা মিয়া। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। গাছের প্রতি রয়েছে তার অগাধ ভালোবাসা। সে ভালোবাসা থেকেই বৃক্ষপ্রেমী এই মানুষটি গাছের পেছনে ছুটছেন ৩০ বছর ধরে। প্রকৃতিকে শীতল করতে এ পযর্ন্ত তিনি ২৫ হাজারেরও বেশি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করেছেন। পরিবশে রক্ষায় তার এই কাজ এলাকায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের মোগড়া এলাকার মৃত মুতি মিয়ার ছেলে গাছপাগল মাওলা মিয়া। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি বিগত ৩০ বছরে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম, কবরস্থান, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, সরকারি অফিস, হাট-বাজার, বিভিন্ন রাস্তাঘাট, মোড়, ঈদগাহ মাঠ ও সরকারি খালি জায়গায় যেখানে সুবিধা পেয়েছেন সেখানেই গাছ লাগিয়েছেন। তার লাগানো গাছের মধ্যে কৃষ্ণচূড়া, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, মেহগনি, কদবেল, চালতা, আমড়া, জামরুল, বকুল ফুল রয়েছে। ওইসব গাছের মধ্যে শতশত মানুষ, পশু ও পাখি আশ্রয় নিচ্ছে। তবে গাছ লাগানোকে তিনি সন্তান জন্ম দেওয়া ও লালন পালনের মতো মনে করেন। টাকার জন্য নয় একমাত্র ভালোবাসার জন্য নিরলসভাবে এ কাজ করে যাচ্ছেন বৃক্ষপ্রেমী মাওলা মিয়া। 

সবুজের স্বপ্নে বেঁচে থাকা এ মানুষটি গাছ লাগিয়েই থেমে থাকেননি। গাছের গোড়ায় পানি দেওয়ার পাশাপাশি করছেন রক্ষণাবেক্ষণও। যদি কোনো গাছ মরে যায় তাহলে পুনরায় নতুন গাছ রোপণের ব্যবস্থাও তিনি করেছেন। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো বিদেশি বা দ্রুত বর্ধনশীল গাছ তিনি রোপণ করেন না। 

মাওলা অতি দরিদ্র ঘরের সন্তান হওয়ায় প্রাথমিকেই থেমে যায় তার শিক্ষাজীবন। তাছাড়া ছোটবেলায় তার বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারের হাল ধরতে হয়। পাশাপাশি শুরু হয় তার গাছ রোপণ। বাড়ির অদূরে দরুইন শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধিতে সর্বপ্রথম কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। সেখানে আজও বেশ কয়েকটি বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ রয়েছে যা পথিকদের ছায়া দিয়ে চলেছে। আর এই কাজ করে আসছেন জমি বর্গাচাষ কিংবা দৈনিক মজুরিতে কাজ করে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মোগড়া গ্রাম। সামান্য এগুলেই ভারত সীমান্ত। তবে এই সীমান্তের ২০-২৫ কিলোমিটার এলাকায় বেশিরভাগ জনগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় লাগানো রয়েছে তার গাছ। গাছ লাগানোর নেশায় তার সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। তিনি এখনও বিয়ে করেননি। সেই যে শুরু আজ পর্যন্ত চলছে তার গাছ লাগানোর কাজ। টানা ৩০ বছর ধরে ২৫ হাজারের উপর নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন। তিনি যেখানে সুবিধা পাচ্ছেন সেখানেই গাছ লাগিয়ে আসছেন। আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে রোপণ করেছেন। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গাছের যে কী পরিমাণ গুণাগুণ রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গাছ আমাদের যেমন অক্সিজেন দেই, পাশাপাশি ফল দেই, কাঠ দেই, ঔষধি গাছ থেকে ঔষধসহ বিভিন্ন গাছ থেকে আমরা পাচ্ছি সূতা।  

সরেজমিনে মোগড়া উচ্চ বিদ্যালয়, মোগড়া বাজার, শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোস্তফা কামালের সমাধি, গঙ্গাসাগর গণকবর, টনকি দাখিল মাদরাসা, আখাউড়া-কসবা সড়ক, ধাতুর পহেলা, পৌর শহরের দেবগ্রাম, শহীদ স্মৃতি ডিগ্রী কলেজ, হাওড়া বাঁধসহ বিভিন্ন এলাকায় গেলে চোখে পড়বে তার লাগানো সারি সারি গাছ। ওইসব গাছের পেছনে শ্রম এবং নিয়মিত সময় দিয়ে আসছেন। 

মাওলা বলেন, ছোটবেলায় মাঠে গরু চড়াতে গিয়ে প্রখর রোদে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। মাঠে গাছগাছালি না থাকায় কোথাও একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য কোনো ছায়া মিলত না। প্রখর রোদে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতেন এখানে যদি একটি ছায়াবৃক্ষ থাকতো তাহলে কোনো কষ্ট হতো না। সেই ভাবনা থেকে শুরু হয় তার গাছ লাগানো। 

এরপর থেকে এলাকার জনগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গাছ লাগাতে শুরু করেন। শুধু গাছ লাগানো নয়, কীভাবে গাছকে বাঁচানো যায় সে চিন্তাও রয়েছে তার। গাছ রক্ষার জন্য বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি নেন অভিনব কৌশলও। গাছ লাগানোর পর দূরন্ত শিশুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাদের মাঝে বাতাসা ও সন্দেশ বিতরণ করেন। 

তিনি বলেন, শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোস্তফা কামালের সমাধি, গঙ্গাসাগর ৩৩ মুক্তিযোদ্ধার গণকবর, মোগড়া উচ্চ বিদ্যালয়, মোগড়া বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর, সুহিলপুর, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিজ হাতে গাছ লাগিয়েছেন। সময় সুযোগ হলে এসব গাছ প্রায় সময় দেখে আসেন। এগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর যত্ন করেন। যখন দেখেন গাছগুলো ছায়া দিচ্ছে পথচারীসহ শতশত মানুষকে তখন তিনি অনেক খুশি হন এবং আনন্দ পান।

তিনি আরও বলেন, বাড়িতে কোনো স্বজন এলে, কেউ প্রবাসে গেলে কিংবা কোনো ভালো সংবাদ নিয়ে আসলে তাকে উপহার দেন গাছের চারা। তার ইচ্ছে, বাকি জীবনটাও তিনি গাছ লাগিয়ে পার করে দিতে চান।

স্থানীয় বিল্লাল আহমেদ জানান, মাওলা একজন গাছপাগল মানুষ। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তার গাছ নেই। এই উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার গাছ রয়েছে। লোকজন মাওলার গাছের ছায়ার নিচে বসে আনন্দ পান। পাখিদেরও একটি আবাসস্থল হয়েছে। তিনি খুব গরিব মানুষ। দিনে কাজ করে যে টাকা মজুরি পান বেশির ভাগই গাছের জন্য ব্যয় করেন।

সাহারাজ মিয়া বলেন, দেশের জনসংখ্যার ভারসাম্যের জন্য যে বনায়ন প্রয়োজন সে তুলনায় হচ্ছে না। নিজ চেষ্টায় দীর্ঘদিন ধরে মাওলা বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগিয়ে আসছেন। মাওলার ফলজ গাছের ফল একদিকে যেমন মানুষ খাচ্ছে আবার পাখিদেরও খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে।

মোগড়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মতিন জানান, মাওলা একজন সাদা মনের মানুষ। এ মানুষটি অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করলেও দীর্ঘ বছর ধরে পরিবেশ রক্ষায় নিয়মিত গাছ লাগিয়ে এলাকায় এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি শুধু গাছই লাগান না, এর পরিচর্যাও করেন। তিনি মাওলার এ কাজে সহযোগিতা করার জন্য সমাজের বিত্তবান ও হৃদয়বান মানুষদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা বেগম বলেন, মহৎ কাজ করার জন্য মহৎ মানুষের প্রয়োজন যা মাওলার মধ্যে এই গুণটি রয়েছে। তার এই মহৎ উদ্যোগ সফল হোক। সরকারি কোনো সহায়তা থাকলে কিংবা আমাদের যদি কোনো ধরনের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি থাকে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে অবশ্যই মাওলা মিয়াকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করব।

গাজীপুর কথা