ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

শুভ জন্মদিন আবুল মাল আবদুল মুহিত

প্রকাশিত: ১০:২৮, ২৫ জানুয়ারি ২০২২

শুভ জন্মদিন আবুল মাল আবদুল মুহিত

ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, লেখক ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ৮৮তম জন্মদিন আজ মঙ্গলবার। ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের সবার কাছে তিনি ‘শিশু’ নামে পরিচিত। আজ তিনি পা দিলেন ৮৯ বছরে। 

তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের কর্ণধার অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজের দ্বিতীয় পুত্র তিনি। তার মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরীও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।

মুহিত ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তবে জীবনে একবার ক্লাস পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। মেধাবী এই মানুষটিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, শুনেছি আপনি সারা জীবন ভালো রেজাল্ট করেছেন। কখনও কি ক্লাসে ফেল করেছেন? এর উত্তরে অট্টহাসি দিয়ে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, জীবনে একবার ফেল করেছি। আর সেটা ক্লাস ওয়ানে। আমি সাদা খাতা জমা দিয়েছিলাম। তাই ফেল করেছিলাম।’

সাদা খাতা জমা দেওয়া কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে আমাকে কেউ বলে দেয়নি যে খাতায় লিখতে হবে। তাই লিখিনি। ’ 

আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (সিএসপি) এ যোগদানের পর মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব্ পালন করেন। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে তিনি পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন।

তিনি পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চিফ ও উপ-সচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন। ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১-এর জুনে  পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

অর্থনৈতিক কূটনীতিতে মুহিত সবিশেষ পারদর্শী। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় তিনি একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসেন মুহিত। আসার আগেই তার অ্যাপয়ন্টমেন্ট হয়েছিল পরিকল্পনা সচিব হিসেবে। মুহিত পরিকল্পনা কমিশনের সচিব ডেজিগনেট হিসেবে কাজ করলেন তিন মাস। এই সময় বঙ্গবন্ধু তাকে দুটি কাজ দেন। একটি ছিল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার জন্য পরিকল্পনা এবং অন্যটি ছিল জেলা প্রশাসনের গণতন্ত্রায়ন।

বলা হলো যে, মার্চ মাসের মাঝামাঝি মুহিতকে প্রতিবেদন ও সুপারিশ দিতে হবে।  তিনি যথা সময়ে দুটি প্রতিবেদনই পেশ করেন। ১৯৭২ সালের স্বাধীনতা দিবসের বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু এই দুটি কার্যক্রম ঘোষণাও করলেন। কিন্তু তার জীবদ্দশায় সেগুলো বাস্তবায়ন হলো না। এছাড়া এই সময়ে যেসব বিদেশি মিশন ত্রাণ ও পুনর্বাসন নিয়ে আলোচনায় আসতো তাদের সঙ্গে আলোচনায় মুহিতকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তিনি ১৯৭২ সালে এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ মিশনে চলে যান। আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশ মিশন হয়ে গেল বাংলাদেশ দূতাবাস। মুহিত সেখানে অর্থনৈতিক মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দুই বছরের মতো। এই সময়ে বেশ কিছুদিন তিনি ছিলেন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার।

১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্য হলে সেপ্টেম্বরে মুহিত হলেন বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের পক্ষে ভারত বাংলাদেশ শ্রীলংকা গ্রুপের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক, যেখানে ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন নির্বাহী পরিচালক। ১৯৭৩ সালে ডিসেম্বরে সপরিবারে ঢাকায় ফিরে আসেন। পরিবারের জন্য এই ছিল স্বাধীন বালাদেশে প্রথম পদার্পণ। ঢাকায় থাকেন জুন পর্যন্ত।
 
১৯৭৪ সালে মে মাসে ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়েই হুকুম পেলেন যে, তাকে ইসলামী মন্ত্রী সম্মেলনে যেতে হবে কুয়ালালামপুর এবং তারপর ঢাকায় যেতে হবে পাকিস্তনের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা ভ্রমণকালে। ভুট্টোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় তাকে বাংলাদেশ ডেলিগেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ সময় তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়ে প্রতিবেদন ও সুপারিশ প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৪-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের মে পর্যন্ত মুহিত ছিলেন ম্যানিলায় অবস্থিত এডিবিতে বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর।

১৯৭৭-৮১ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১-৮২ মার্চ পর্যন্ত তিনি স্বাধীনভাবে নানা কনসালটেন্সি  করেন।

১৯৮২ সালে মার্চ মাসে জেনারেল এরশাদের স্বল্পমেয়াদি নির্দলীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে মুহিত অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৩ মে থেকে হলেন সবেতন মন্ত্রী। ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রীত্বে ছিলেন ২০ মাস।  এর মধ্যে ২টি বাজেট পেশ করেছিলেন। মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করার সময় অনেক দ্বিধাবোধ ছিল তার। সামরিক সরকারের একজন হতে খুব আপত্তি ছিল। তাই অনেক রিজার্ভেশনসহ তখন মন্ত্রী হন তিনি।

১৯৮২-১৯৮৩ এবং ১৯৮৩-১৯৮৪ অর্থবছরে ২টি এবং ২০০৯-২০১০ অর্থবছর থেকে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ১০টিসহ মোট ১২টি জাতীয় বাজেট জাতিকে উপহার দেন।

১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।

লেখক হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত সমান পারদর্শী। প্রশাসনিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তার ৩৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে (বাপা) তিনি একজন পথিকৃত এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার।

স্ত্রী সৈয়দ সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ।  বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সামির মুহিত শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন-যপন করলেও সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে নীরবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি বই পড়ে এবং লেখালেখি করে সময় কাটাচ্ছেন।

গাজীপুর কথা