ঢাকা,  মঙ্গলবার  ২৩ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

১৭ অক্টোবর, ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ১৭ অক্টোবর ২০২১

১৭ অক্টোবর, ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী

'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়, তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি দিতাম পাখির পায়' —মানুষের ভেতরে এই অচিন পাখিকেই খোঁজ করেছেন তিনি। তিনি মানুষের ভেতরের মানুষকে চেনা ও মানুষকে ভজন করে পার করে দিয়েছেন এক জীবন। তিনি ফকির লালন সাঁই। আজ তাঁর ১৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালির ছেঁউরিয়ায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রতি বছর এ সময় কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় কালিন্দী নদীর ধারে লালন ভক্ত-সাধকদের মিলনমেলা বসে। হয় তিন দিন ধরে অনুষ্ঠান। এবছর করোনাকালের জন্য সেই অনুষ্ঠান হচ্ছে না। তার পরেও ভক্ত অনুসারীরা অনেকেই লালন সাঁইকে ভক্তি জানাতে তার মাজারে উপস্থিত হয়েছেন।
আমাদের কুষ্টিয়ার স্টাফ করেসপন্ডেন্ট এসএম জামাল জানিয়েছেন, এরই মধ্যে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ীতে লালন ভক্ত-সাধকরা চলে এসেছেন। অডিটোরিয়ামের নিচে শতশত ভক্ত আসন গেড়ে বসেছেন। তারা নিয়ম মেনেই তিরোধান দিবসের কার্যাদী সম্পন্ন করবেন।
লালন একাডেমির সভাপতি ও কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানান, বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি এবং গণজমায়েতের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধ আরোপ থাকাসহ সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনা করে আসন্ন তিরোধান দিবস পালন (লালন মেলা, আলোচনা সভা এবং লালন সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন) করা সম্ভব হচ্ছে না।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো - সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ ২০ জন বাঙালির তালিকায় ১২তম স্থানে আসেন সাধক লালন ফকির। লালন ফকির ছিলেন একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক। তাঁর গানের মধ্যে সন্ধান পাওয়া যায় এক বিরল মানব দর্শনের।
লালন শাহ, যিনি লালন ফকির বা লালন সাঁই নামেও পরিচিত, তিনি মৃত্যুর ১৩১ বছর পর আজও বেঁচে আছেন তাঁর গানের মাঝে। তাঁর লেখা গানের কোন পাণ্ডুলিপি ছিল না, কিন্তু গ্রাম বাংলায় আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তাঁর রচিত গান ছড়িয়ে পড়ে লোকের মুখে মুখে। লালন ফকিরকে 'বাউল-সম্রাট' বা 'বাউল গুরু' হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাঁর গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি প্রায় দু হাজার গান রচনা করেছিলেন বলে লালন গবেষকরা বলেন।
তার কর্ম সবার জানা কিন্তু তার ধর্ম আজও অজানা। তার জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কোন কোন গবেষক ধারণা করছেন তিনি অবিভক্ত বাংলার বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন তিনি ১৭৭৪ সালের ১৭ অক্টোবর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
লালন গবেষক ফকির হৃদয় সাঁই বলেন, কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার এক গভীর জঙ্গলে সাধক শিরোমনি ফকির লালন শাহ তার অনুসারী ভক্তদের নিয়ে যে আখড়া গড়ে তুলেছিলেন তা এখন সারা বিশ্বের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ফকির লালন শাহ তার গানের বাণীর ভেতর দিয়ে একটি সুসংঘবদ্ধ জীবন বিধানের নির্দেশনা দিয়েছেন। তার গান এক গভীর দ্যোতনায় এই বিশ্ব-সংসার, মানবধর্ম, ঈশ্বর ও ইহলৌকিক ও পারলৌকিকতা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য করে। সব মরমী সাধকেরই পরম্পরা থাকে। তবে লালনের দ্যুতি এমনই তীব্র ও রহস্যময় যে তারপরে আর কোনো মরমী সাধক নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি। দুই শতাব্দী ও চার দশক পেরিয়ে গেলেও আজও লালন মরমী জগতের সার্বভৌম ব্যক্তি।
তিনি বলেন, আমরা এই ধামে বছরে দুইবার আসি। এই পহেলা কার্তিকে তিরোধান দিবস এবং দোল উৎসবে। গেলো অনুষ্ঠানে প্রধান ফটক তালা দেওয়া থাকায় আমরা ভেতরে ঢুকতে পারিনি। এবারও তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠান না হলেও আমরা ভক্ত সাধকরা হাজির হয়েছি।
লালন একাডেমির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সেলিম হোসেন বলেন, যত দিন যাচ্ছে ফকির লালন সাঁইয়ের জীবন ও গানের ব্যাপ্তি ততই প্রভাব বিস্তার করছে মানুষের মাঝে। ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন, মৃত্যু হয়েছে ১৩১ বছর আগে। এই দীর্ঘ সময়ও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাননি। বরং তার সৃষ্টির ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে, বেড়েছে পরিধি। ফকির লালন শাহ শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে এক ঐন্দ্রজালিক মোহময়তা বিস্তার করে চলেছেন। দিনদিন তার সে ঐন্দ্রজালিক বলয়ের বিস্তৃতি ঘটছে। অগণিত মানুষ তার বিশাল সৃষ্টি জগতে প্রবেশ করে সন্ধান করছেন যেন লালনেরই।
এদিকে, শিল্পকলা একাডেমি ফকির লালনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গতকাল স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আয়োজন করা হয়েছিল সাধুমেলার। পাশাপাশি সাধক বাউলদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। লালন গবেষণা ও সাধনায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রথম বারের মতো সাত জন লালন গবেষক ও সাধককে সম্মাননা স্মারক প্রদান করে।
লালন গবেষণায় সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয় অধ্যাপক ড. আবুল আহসান চৌধুরী এবং অধ্যাপক ড. শক্তিনাথ ঝা (ভারত)। লালন সাধনায় সম্মাননা দেওয়া হয় পার্বতী দাস বাউল (ভারত), ফকির মোহাম্মদ আলী শাহ (কুষ্টিয়া), ফকির আজমল শাহ্ (ফরিদপুর), নিজাম উদ্দিন লালনী (মাগুরা), শুরু বালা রায় (ঠাকুরগাঁও)। সম্মাননা স্মারক হিসেবে প্রত্যেককে দেওয়া হয় ক্রেস্ট, স্মারকপত্র ও ২৫ হাজার টাকা। সম্মাননা ভারতের দুজন ব্যক্তিত্ব করোনার নিষেধাজ্ঞার জন্য আসতে পারেননি। তাদের পুরস্কার পরবর্তী সময়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।

গাজীপুর কথা