ঢাকা,  শনিবার  ২০ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

ফেসবুকের সহায়তায় ৭০ বছর পর মায়ের বুকে ফিরলেন ছেলে

প্রকাশিত: ১৭:১৭, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফেসবুকের সহায়তায় ৭০ বছর পর মায়ের বুকে ফিরলেন ছেলে

হারিয়ে যাওয়ার ৭০ বছর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণের ১০ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া একমাত্র ছেলে কুদ্দুছ মিয়া (৮০) কে ফিরে পেলেন মা মঙ্গল নেছা (১১০)। এসময় সে তার সন্তানকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বলেন ‘আহ মানিক আমার বুকে আয়’।

শনিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আশ্রাফবাদ গ্রামে কুদ্দুস মিয়ার বোন ঝর্ণা বেগমের বাড়িতে মা ছেলের এ ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ হয়। ছেলেকে ফিরে পেয়ে ১১০ বছর বয়সী মা আবেগে আপ্লুত হয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছেলে ও মাকে ফিরে পেয়ে মাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত শতাধিক নারী পুরুষের চোখের পানি চলে আসে।

কুদ্দুসকে হারিয়ে ফেলার পর থেকেই তার বিধবা মা দুই মেয়েকে নিয়ে হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন, তার সে স্বপ্ন আজ পূরণ হলো। হারিয়ে যাওয়া ১০ বছরের একমাত্র ছেলে কুদ্দুছ মিয়া আজ ৭০ বছর পর ফিরে এলেন মায়ের কোলে।

সাত দশক পর সাক্ষাতের সময় মা বলেন, কুদ্দুছ তুই একদিন ফিরে আসবি এটা আমি বিশ্বাস করতাম, আল্লাহর কাছে এই দোয়াই করেছি, আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন।

হারিয়ে যাওয়া ১০ বছরের কিশোর কুদ্দুস মুন্সি এখন ৮০ বছর বয়সী প্রবীণ। তার তিন ছেলে ও ৫ মেয়ে রয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি নবীনগর উপজেলার সলিমগঞ্জ ইউনিয়নের বাড্ডা গ্রামে। তবে গ্রামে তারা কেউ আর বসবাস করেন না।

জানা যায়, কুদ্দুছ মুন্সির বয়স যখন ৭ বছর, তখন তার বাবা কালু মুন্সি মারা যান। এরপর মা মঙ্গল নেছা ১০ বছর বয়সী ছেলেকে লেখাপড়া করাতে প্রতিবেশী নিকটাত্নীয় পুলিশ সদস্য আব্দুল আউয়ালের সাথে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় পাঠান। সেখানে আবদুল আউয়ালের স্ত্রী বকুনিতে অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান কুদ্দুছ মুন্সি। অনেক খোঁজাখুজি করেও কুদ্দুসের আর খোঁজ পাননি আউয়াল মিয়া।

এদিকে, ঘুরতে ঘুরতে কুদ্দুছ মুন্সি পৌঁছান নওগাঁর আত্রাইয়ের সিংহগ্রামে। সেখানে নিঃসন্তান সাদেক মিয়ার স্ত্রী তাকে লালন পালন করেন। ৩০ বছরে বয়সে আত্রাইয়ের চৌবাড়ি গ্রামের শুরুজ্জাহানকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতেই বসবাস করতে থাকেন। কুদ্দুস মিয়ার প্রথম স্ত্রী মারা গেলে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন বাগমারা উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামে। এখন সেখানেই থিতু হয়েছেন।

তার ৩ ছেলে ও ৫ মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলে রাজ্জাক মুন্সি ইরাকে ও দ্বিতীয় ছেলে জান্নান মুন্সি সৌদি আরব থাকেন। ছোট ছেলে হাফেজ সোহেল মুন্সি বাড়িতেই থাকেন। ৫ মেয়ের সবার বিয়ে হয়ে গেছেন।

উল্লেখ্য, এমকে আইয়ূব এক ব্যক্তি তার ফেসবুক আইডিতে কুদ্দুছ মিয়ার হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটি ভিডিও আপলোড করেন গত ১২ এপ্রিল। ফেসবুকের ওই পোস্টের ওপরে লিখেছিলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার এক বৃদ্ধ আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে হারিয়ে গিয়ে পরিবার থেকে এতগুলো বছর বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। কেউ যদি তার কথা শুনে চিনতে পারেন তাহলে যোগাযোগ করুন। এরপর বাকিটা ইতিহাস। সাড়া পড়ে যায় এবং পরিবারের খোঁজ মেলে। দেশে ও বিদেশে ভাইরাল হয় ভিডিওটি।

এই ভিডিওর সূত্র ধরে গত ৫ সেপ্টেম্বর কুদ্দুছ মিয়ার নিজ গ্রাম নবীনগর উপজেলার কয়েকজন যোগাযোগ করেন আইয়ূবের সাথে। তারা সেখানে যান এবং ভিডিও কলে কুদ্দুস মিয়ার মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দেন। ছেলের হাতে কাটা চিহ্ন দেখে মা শনাক্ত করেন। .

শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুদ্দুছ মিয়া, ছেলে এবং ছেলের স্ত্রীরা কুদ্দুসের মায়ের সাথে দেখা করতে তার ছোটবোনের বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আশ্রাফবাদ গ্রামে যান।

কুদ্দুস মিয়া জানান, হারিয়ে যাওয়ার পর নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার সিংহগ্রামে গ্রামের সাদিক মিয়ার স্ত্রী আমাকে ছেলের মত লালন পালন করেন। পরবর্তীতে বিয়ের পর আমার শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করে আসছি। কিন্তু মনে মনে আমার মা ও বোনদের খোঁজার চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্বাস ছিল একদিন আমার মায়ের সন্ধান আমি পাবো। মায়ের বুকে ফিরতে পেরে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে, বাকি জীবনটা মায়ের সাথেই থাকবো।

বাড্ডা গ্রামের শফিকুল ইসলাম জানান, ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখে আমরা কয়েকজন রাজশাহীর বাঘমারায় যোগাযোগ করি ও সেখানে যাই। মা ছেলের মধ্যে ভিডিও কলে কথা বলাই। ছেলের হাতের কাটা দাগ আছে এমন কথা কলার পর আমরা মিলিয়ে দেখি এবং তাকে আজ মায়ের কাছে নিয়ে এসেছি।

কুদ্দুস মিয়ার ভিডিও ফেসবুকে পোষ্টকারী নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার ব্যবসায়ী এমকে আইয়ূব জানান, কুদ্দুছ চাচার হারিয়ে যাওয়ার গল্প শুনে আমি চাচার একটি ভিডিও আপলোড করি। সে ভিডিওর সূত্র ধরে তার বাড়ির কিছু লোকজন আমার সাথে যোগাযোগ করে এবং হাতের কাটা দেখে তাকে শনাক্ত করে তার মায়ের কথামত। আমার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে ৭০ বছর পর মা তার ছেলেকে ফিরে পেয়েছে, তাতে আমার অনেক আনন্দ লাগছে।

কুদ্দুছ মিয়ার ছেলে হাফেজ সোহেল মুন্সি জানান, কোনোদিন ভাবিনি আমার বাবা তার মাকে ফিরে পাবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হয়েছে, আল্লার কাছে শুকরিয়া।

কুদ্দুছ মিয়ার বোন ঝরনা বেগম জানান, আমার মা সবসময় বলতেন একদিন আমার ছেলে ফিরে আসবে। আল্লাহ আমার মার ডাক কবুল করেছেন। আমরা আমার ভাইকে ফিরে পেয়েছি।

গাজীপুর কথা