ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

ঈদের ছুটিতে পর্যটক টানছে ভাওয়াল গড়

প্রকাশিত: ১৪:৩৮, ৫ মে ২০২২

ঈদের ছুটিতে পর্যটক টানছে ভাওয়াল গড়

ঈদের ছুটিতে কর্মব্যস্ত মানুষেরা চিত্ত-বিনোদনের জন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রতিবারের মত নয়নাভিরাম সবুজ প্রকৃতির টানে সারা দেশ থেকেই ভ্রমণ পিয়াসীরা ভিড় জমাচ্ছেন গাজীপুর। ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যে ঘেরা ভাওয়ালের গড়ে।

পাঠকদের জন‌্য তুলা ধরা হলো গাজীপুর জেলার বিভিন্ন পার্ক ও রিসোর্টের সৌন্দর্য, সুযোগ-সুবিধা, যাতায়াত ও খরচের কথা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক : গাজীপুরে চিত্ত-বিনোদনের ভরসা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক ও ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান (ন্যাশনাল পার্ক)। ছুটির দিনগুলোতে সপরিবারে বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক ও ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন ছুটে যান। এছাড়াও গাজীপুরে ধনী ও বিত্তশালীদের জন্য রয়েছে শত শত কটেজ ও রিসোর্ট।

রাজধানী ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর সদর উপজেলার পীরুজালী ও শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের মধ্যে ৩৮১০ একরের বিশাল এলাকা নিয়ে সাফারি পার্কটি গড়ে উঠেছে।

পার্কটিকে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন বন্যপ্রাণি যেন অবাধে বিচরণ এবং একই সাথে পার্কে ঘুরতে আসা পর্যটকদের চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করতে পারে সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে। যে কারণে ইতোমধ্যেই দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

যা যা দেখতে পাবেন : সাফারি পার্কে ঘুরতে আসা পর্যটকরা প্রোটেকটেড মিনিবাসে চড়ে অথবা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে বনাঞ্চলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচারণরত বিভিন্ন বন্যপ্রাণি দেখতে পারবেন। এ বনে বাঘ, সিংহ, হাতি, সাম্বার, মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, বানর, হনুমান, ভাল্লুক, গয়াল, কুমির ও বিচিত্র পাখির অবাধ বিচরণ। লেকের ধারে অথবা পাখিশালায় দেখতে পাবেন অসংখ্য অতিথি ও জলজ পাখি।

কোর সাফারি, সাফারি কিংডম, বায়োডাইভার্সিটি পার্ক, এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারি পার্ক এবং বঙ্গবন্ধু স্কয়ার এই পাঁচটি অংশে বিভক্ত সাফারি পার্ক। কোর সাফারি এলাকায় গাড়ি ছাড়া কোনো পর্যটক প্রবেশ করতে পারবেন না। দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে দুটি জিপ ও দুটি মিনিবাস। পর্যটক বা দর্শনার্থীরা নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে গাড়ি বা জিপে করে প্রকৃতিক পরিবেশে ছেড়ে রাখা বন্যপ্রাণি দেখতে পারবেন। কোর সাফারি পার্কের মধ্যে আছে– বাঘ, সিংহ, কালো ভাল্লুক, আফ্রিকান চিতা, চিত্রা হরিণ, সাম্বার, গয়াল, হাতি, মায়া ও প্যারা হরিণ।
 
সময়সূচি : সাফারি পার্ক প্রতি মঙ্গলবার বন্ধ থাকে। এছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেলে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

খাওয়া দাওয়ার সুবিধা : গাজীপুর সাফারি পার্কে আছে দুটি বিশালাকারের পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ। একটির নাম টাইগার রেস্তোরাঁ অপরটি সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্তোরাঁ। এই দুটি রেস্টুরেন্টে বসে কাচের মধ্যে দিয়ে সিংহ এবং বাঘ দেখতে দেখতে খাওয়া যায়।

যাতায়াতের ব্যবস্থা : প্রাইভেট কার থাকলে কোনো ঝামেলা ছাড়াই চলে যাওয়া যাবে গাজীপুর সাফারি পার্কে। পার্কেই রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা। এছাড়াও ঢাকা থেকে বাসে করে গাজীপুর বাঘের বাজার নামতে হবে। এরপর সিএনজি অটোরিকশা অথবা রিকশাযোগে ২০ মিনিটে পৌঁছে যেতে পারবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক।

প্রবেশ মূল্য : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের প্রবেশ মূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৫০ টাকা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ২০ টাকা। কোর সাফারি পার্ক পরিদর্শনের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের টিকেট ১০০ টাকা ও শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০ টাকা।

ন্যাশনাল পার্ক : লাল মাটির উর্বর ভূমিতে সহস্র বছর আগেই জমে উঠেছিল বৃক্ষের আখড়া। আকর্ষণীয় সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্রের কারণে ক্রমেই ভাওয়ালের গড় পরিণত হয়েছে পর্যটকদের পছন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের প্রধান বৃক্ষ গজারি। এ কারণে একে ভাওয়ালের গজারির গড়ও বলা হয়। দেশে যে কয়টি বৃহৎ প্রাকৃতিক বনভূমি রয়েছে তার মধ্যে ভাওয়ালের গড় অন্যতম। ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যে ভাওয়াল গড়ের তুলনা হয় না।

পাঁচ হাজার ২২ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত উদ্যানজুড়ে ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্ক গড়ে তোলা হয়। এখানে পর্যটকদের জন্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তার ব‌্যবস্থা করা হয়। এক কথায় বনকে ঘিরে গড়ে তোলা হয় মনোরম পিকনিক স্পট, তথা একটি অত্যাধুনিক রিসোর্ট।

এখানে পর্যটকদের জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় কয়েকটি পিকনিক স্পট। আনন্দ, কাঞ্চন, সোনালু, অবকাশ, অবসর, বিনোদন প্রভৃতি বাহারি নাম তাদের। দর্শনার্থীদের আরামের জন্য রয়েছে বকুল, মালঞ্চ, মাধবী, চামেলী, বেলী, জুঁই প্রভৃতি নামের চমৎকার ও মনোরম কটেজ। এখানে ১৩টি কটেজ ও ছয়টি রেস্টহাউস রয়েছে। উদ্যানের সৌন্দর্য একসঙ্গে উপভোগ করার জন্য রয়েছে একাধিক সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। যেখানে দাঁড়িয়ে আপনি চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন হাজার হাজার বৃক্ষ সমাদৃত সবুজ রাজ‌্যের ওপর।

পারিবারিকভাবে দলবদ্ধ ভ্রমণের জন্য ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানটি একটি সুন্দরতম স্থান। সবুজেঘেরা কোলাহলমুক্ত বনানী পরিবেশের জন্য এ উদ্যান বিখ্যাত। এই জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য জলাশয়। এসব জলাশয়ে শৌখিন পর্যটকরাও নৌকায় করে বেড়াতে পারেন। এছাড়া বনভোজনের সেরা আকর্ষণ হচ্ছে এই ভাওয়ালের ন্যাশনাল পার্কটি। পিকনিক স্পট কিংবা রেস্ট হাউস ব্যবহার করতে হলে বন বিভাগের মহাখালী কার্যালয় থেকে আগাম বুকিং দিয়ে নিতে হবে।

সতর্কতা : উদ্যানের বেশি গহিনে না যাওয়াই ভালো। একাকী গেলে ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে পারেন। জঙ্গলে ভ্রমণের সময় অবশ্যই আরামদায়ক কাপড় ও জুতা পরবেন। দূরের পাখি দেখতে সঙ্গে নিতে পারেন দূরবীন। বনের ভেতর একা না যাওয়াই ভালো। পশু পাখি বিরক্ত হয় এমন শব্দ ও কোলাহল করা থেকে আপনাকে বিরত থাকতে হবে। তাছাড়া পলিথিন, ক্যান, প্লাস্টিকের বোতল ফেলে কোনোভাবেই বন ময়লা করবেন না। ভাওয়াল উদ্যানের কিছু অংশ অরক্ষিত। তাই সাবধানতা অবলম্বন না করলে বিপদ হতে পারে।

প্রবেশ মূল্য : ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা। গাড়ি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে নির্দিষ্ট হারে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা আছে। ভেতরে ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে ঘোড়ার গাড়ি ও রিকশা।

যেভাবে যাবেন : ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়েকর পাশেই ভাওয়াল উদ্যান। দেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে আপনি ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান আসতে পারেন সহজেই। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী যেকোনো বাসে চড়ে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের ফটকের সামনেই নামা যায়।

নুহাশ পল্লী : হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিবিজড়িত প্রাকৃতিক নৈসর্গ নুহাশ পল্লী। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে হোতাপাড়া বাজার। সেখান থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে পিরুজালী গ্রামে অবস্থিত নুহাশ পল্লী। এটি ৪০ বিঘা জমি নিয়ে তৈরি। একেবারে জঙ্গলের ভিতরে হঠাৎ করে এক টুকরো পরিচ্ছন্ন উদ্যান।

নুহাশ পল্লীতে যা যা দেখতে পাবেন : নুহাশ পল্লীতে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ ঔষধি, মসলা জাতীয়, ফলজ ও বনজ গাছ রয়েছে। সবুজ মাঠের মাঝখানে একটি বড় গাছের ওপর ছোট ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছে। বাগানের এক পাশে ‘বৃষ্টি বিলাস’ নামে অত্যাধুনিক একটি বাড়ি রয়েছে। নুহাশ পল্লীর আরেক আকর্ষণ ‘লীলাবতী দীঘি’। দীঘির চারপাশ জুড়ে নানা রকমের গাছ। রয়েছে সানবাঁধানো ঘাট। পুকুরের মাঝখানে একটি দ্বীপ। সেখানে অনেকগুলো নরিকেল গাছ। এছাড়া এখানে দেখা মিলবে হুমায়ূন আহমেদের আবক্ষ মূর্তি ও সমাধিস্থল, পদ্মপুকুর, সরোবরে পাথরের মৎসকন্যা। বৃষ্টিবিলাসসহ তিনটি বাংলো রয়েছে এই সেখানে।

যেভাবে যাবেন : ঢাকার মহাখালী থেকে আসতে চাইলে সম্রাট লাইন, রাজদূত পরিবহন বা অন্যকোনো বাসে চড়ে হোতাপাড়ায় নেমে সিএনজি চালিত অটোরিকশা, লেগুনা বা যান্ত্রিক রিকশায় নুহাশ পল্লীতে যেতে পারবেন।

টিকেট মূল্য এবং সময়সূচি : নুহাশ পল্লী সারা বছর দর্শনার্থীদের জন্যে খোলা থাকে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বিশেষ অনুরোধে মাগরিবের আজান পর্যন্ত সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য খোলা রাখা হয়। নুহাশ পল্লীতে ১২ বছরের ওপরে জনপ্রতি প্রবেশ মূল্য ২০০ টাকা।

এছাড়াও নভেম্বর থেকে মার্চ মূলত পিকনিকের জন্য ভাড়া দেয়া হয়। প্রতিদিন পিকনিকের জন্য একটি গ্রুপে সর্বোচ্চ ৩০০ জন যেতে পারবে। সরকারি ছুটির দিনে পিকনিকের জন্য গুনতে হবে ৬০ হাজার টাকা, অন্যদিন ৫০ হাজার টাকা। সরকারি ছুটির দিনে পিকনিকের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাড়া পড়বে ৫০ হাজার টাকা।

রিসোর্ট : জোছনা দেখতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন জল জঙ্গলের কাব্য থেকে। বিলের ওপর জোছনার আলো এক অন্য রকম অনুভূতি দেবে আপনাকে। অল্প খরচে সারাদিন ঘুরে আসার জন্য এর চেয়ে ভাল জায়গা আর হয় না। দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ ও বিলাসিতা উপভোগ করতে চলে আসতে পারেন ভাওয়াল রিসোর্ট, ছুটি রিসোর্ট, সারা রিসোর্ট। এগুলো ছাড়াও ঢাকা রিসোর্ট, রাঙামাটি রিসোর্ট, আনন্দ পার্ক, সোহাগ পল্লীসহ শতশত পার্ক ও রিসোর্ট রয়েছে গাজীপুর।

এসব রিসোর্টে একটি রাত যাপন করতে একজনের খরচ পড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে। এসব রিসোর্টে শুধু দিনে ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া ও সুইমিংপুলে গোসল করতে খরচ করতে হয় জনপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা। এছাড়াও ২ হাজার থেকে ৫ হাজারের মধ্যেও রাত্রি যাপন কিংবা চিত্র বিনোদনের সুযোগ রয়েছে।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন