ঢাকা,  বুধবার  ২৪ এপ্রিল ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

হিমালয়ে আজও কী লুকিয়ে আছে ‘জ্ঞানগঞ্জ’?

প্রকাশিত: ১৯:২৮, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

হিমালয়ে আজও কী লুকিয়ে আছে ‘জ্ঞানগঞ্জ’?

পৃথিবীর একটি সুন্দরতম স্থান ‘হিমালয়’। পশ্চিমের নাঙ্গা পর্বত থেকে পূর্বের নামচা বারওয়া, প্রায় ২৪০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আছে হিমালয়। যা মানুষের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে সেই অদিকাল থেকেই। যুগ যুগ ধরে প্রকৃতিপ্রেমীরা হিমালয়ের কাছে যায়, অবর্ণনীয় রূপে অবগাহনের জন্য।

সব বাধা পেরিয়ে এখানে কেউ যায় তুষার শৃঙ্গে আরোহণ করে নিজের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছবার উদ্দেশ্য নিয়ে। আর একদল মানুষ সংসার ত্যাগ করে জীবনের গভীর অর্থ খুঁজে বের করার জন্য যায় হিমালয়ে। গৈরিকধারী এই মানুষগুলোর কাছে হিমালয় হলো এই গ্রহের সবচেয়ে রহস্যময় স্থান। কারণ হিমালয়ের যে অংশে মানুষের পদচিহ্ন আজও পড়েনি, সেখানেই লুকিয়ে আছে এমন সব রহস্য, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না। ‘ইয়েতি’ ও ‘রূপকুণ্ড’ রহস্য জনসমক্ষে চলে এলেও হিমালয়ের অন্তপুরে লুকিয়ে আছে এরকম কত শত অজানা রহস্য।

সে রকমই জটিল এক রহস্য লুকিয়ে আছে হিমালয়ের নিশ্ছিদ্র কুয়াশার অন্তরালে। হিমালয়কে ঘিরে বাস করা কয়েকটি গোষ্ঠী অত্যন্ত গোপনে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে নিয়ে চলেছেন এই রহস্যের মশাল, যার নাম ‘জ্ঞানগঞ্জ’ (Gyanganj)। এই রহস্য ভেদ করা আজও সম্ভব হয়নি।

জ্ঞানগঞ্জ হলো হিমালয়ের দুর্গম স্থানে লুকিয়ে থাকা এক রহস্যময় নগররাষ্ট্র। তিব্বতে এই নগররাষ্ট্রটিকে বলা হয়ে শাম্বালা। ভারতে বলা হয় জ্ঞানগঞ্জ বা সিদ্ধাশ্রম। এই নগররাষ্ট্রে প্রবেশ করার অধিকার সাধারণ মানুষের নেই। কারণ জ্ঞানগঞ্জ হল অমরলোক। এখানে কারো মৃত্যু হয় না। চেতনা এখানে সদা জাগ্রত থাকে।

হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের উচ্চকোটির যোগী, সাধু, ঋষি, মুনি ও সিদ্ধপুরুষরাই কেবলমাত্র জ্ঞানগঞ্জে বাস করার আমন্ত্রণ পান। তবে সিদ্ধপুরুষ হলেই জ্ঞানগঞ্জে প্রবেশের অনুমতি মেলে না। যারা জীবনে একটিও পাপ করেননি, কেবলমাত্র সেইসব সিদ্ধপুরুষরাই সর্বোচ্চ জ্ঞানলাভ করার জন্য এই আধ্যাত্মিক নগরীতে প্রবেশ করতে পারেন। কারণ, জ্ঞানগঞ্জে লুকিয়ে রাখা আছে এই গ্রহের সর্বোচ্চ জ্ঞান। যে জ্ঞান পৃথিবীর ভাগ্য নির্ধারণ করে।

জ্ঞানগঞ্জের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। হিমালয়ের এক গোপনস্থানে, সিদ্ধ-হ্রদ নামে একটি সুবিশাল হ্রদকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছে এই নগররাষ্ট্রটি। জ্ঞানগঞ্জের সুদৃশ্য বাড়ি ও প্রাসাদগুলো বর্ণময় পাথর দিয়ে তৈরি। বাড়ি ও প্রাসাদের দেয়ালগুলোতে খোদাই করা আছে জ্ঞানগঞ্জের প্রতীক। যে প্রতীকে দেখতে পাওয়া যাবে আট পাপড়ি যুক্ত একটি পবিত্র পদ্মফুলকে। পদ্মটিকে ঘিরে আছে তুষারাচ্ছাদিত পর্বতমালা। পদ্মের মাঝখানে ঝলমল করছে অতীব উজ্জ্বল একটি স্ফটিক।

 

শিল্পীর কল্পনায় ‘জ্ঞানগঞ্জ’।

শিল্পীর কল্পনায় ‘জ্ঞানগঞ্জ’।

দিনের বিভিন্ন সময় বদলে যায় জ্ঞানগঞ্জের পরিবেশ। গিরগিটি যেমন বিপদের আশঙ্কায় রূপ বদলে প্রকৃতিতে মিশে যায়। ঠিক সেরকমভাবেই হিমালয়ের বুকে প্রকৃতির রঙের মধ্যে হারিয়ে যায় জ্ঞানগঞ্জ। তাই ধরা পড়ে না সাধারণ চোখে। তাই নগররাষ্ট্রটির অবস্থান সম্পর্কেও কারো কোনো ধারণা নেই।

বারবার রূপ বদলানোর ফলে জ্ঞানগঞ্জের হদিশ নাকি দিতে পারছে না বিজ্ঞানও। সত্যিই হিমালয়ে এরকম কোনো নগররাষ্ট্রের ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পায়নি স্যাটেলাইট। অথচ অসংখ্য হিন্দু ও বৌদ্ধ পুরাণে হিমালয়ে লুকিয়ে থাকা এই নগররাষ্ট্রটির উল্লেখ আছে।

হিন্দু বা সনাতন ধর্মে জ্ঞানগঞ্জের নাম ‘সিদ্ধাশ্রম’। সিদ্ধপুরুষদের নির্জন আবাস হলো ‘সিদ্ধাশ্রম’। সিদ্ধাশ্রমের কথা বলা হয়েছে চতুর্বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারতসহ বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথিতে। বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে সিদ্ধাশ্রম হলো শ্রীবিষ্ণুর সর্বশেষ অবতার বা কল্কি অবতারের জন্মভূমি। পুরাণ অনুসারে এই সিদ্ধাশ্রমের অবস্থান, বামন অবতার হয়ে মর্ত্যে আসা শ্রীবিষ্ণুর আশ্রমের পূর্বদিকে।

বাল্মিকী রামায়ণে বলা হয়েছে, সিদ্ধাশ্রমের আবাসিক ছিলেন মহামুনি বিশ্বামিত্র। সিদ্ধাশ্রমের পরিবেশকে কলুষিত করা এক দানবকে শাস্তি দেওয়ার জন্য রাম লক্ষ্মণকেও তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন সিদ্ধাশ্রমে। নারদপুরাণে বলা হয়েছে হিমালয়ের গভীরে থাকা সিদ্ধাশ্রম হলো সাধু উগ্রসবস সৌতির আশ্রম। যেখানে তপস্যারত অবস্থায় আছেন অনেক সিদ্ধযোগী ও যোগিনী।

অন্যদিকে হিমালয়ে বসবাসরত অনেক সন্ন্যাসী বিশ্বাস করেন মহর্ষি বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, কণাদ, পুলস্ত্য, অত্রি, মহাযোগী গোরখনাথ, শঙ্করাচার্য্যদের মতো মহাপুরুষদের বাসভূমি হলো ‘সিদ্ধাশ্রম’। সেখানে গেলে আজও দেখা যাবে তাদের। শোনা যাবে তাদের বাণীও। কারণ তারা সিদ্ধাশ্রমে অমর হয়ে আছেন।

হিমালয়ের অন্দরে লুকিয়ে থাকা এই নগররাষ্ট্রটিকে বৌদ্ধধর্মে বলা হয়েছে ‘শাম্ভালা’। শাম্ভালার উল্লেখ আছে বৌদ্ধ ধর্মের ‘কালচক্র’ তন্ত্র ও সুপ্রাচীন তিব্বতীয় পুঁথি ঝাংজুং-এও। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন, জীবনের শেষপর্বে ভগবান বুদ্ধ ‘কালচক্র’ রূপ ধারণ করেছিলেন। এবং সারাজীবন ধরে যা জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা জানিয়ে গিয়েছিলেন কয়েকজন শিষ্যকে। এই শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিলেন শাম্ভালার রাজা সুচন্দ্র বা দাওয়া সাঙ্গপো।

রাজা সুচন্দ্র বা দাওয়া সাঙ্গপোকে বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের অমরাবতীতে ‘কালচক্র তন্ত্র’ বুঝিয়েছিলেন ভগবান বুদ্ধ। রাজগীরের গৃধকূট পাহাড়ে রাজা সুচন্দ্র ও শাম্ভালা রাজ্যের আরো ছিয়ানব্বই জন রাজার সামনে ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ সূত্রটি বর্ণনা করেছিলেন। ভগবান বুদ্ধের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান লিপিবদ্ধ করে শাম্ভালায় নিয়ে গিয়েছিলেন দাওয়া সাঙ্গপো। লুকিয়ে রেখেছিলেন গোপন স্থানে। তিব্বতীরা বিশ্বাস করেন শাম্ভালা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো জায়গায় লিপির আকারে সেই জ্ঞান সংরক্ষিত নেই।

 

হিমালয়ের অন্দরে লুকিয়ে থাকা এই নগররাষ্ট্রটিকে বৌদ্ধধর্মে বলা হয়েছে ‘শাম্ভালা’।

হিমালয়ের অন্দরে লুকিয়ে থাকা এই নগররাষ্ট্রটিকে বৌদ্ধধর্মে বলা হয়েছে ‘শাম্ভালা’।

তিব্বতীয় বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন রহস্যময় শাম্ভালা লুকিয়ে আছে ট্রান্স-হিমালয়ের কোনো দুর্গম জায়গায়। পৃথিবীর যখন ভয়ঙ্কর দুঃসময় আসবে, নীল পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করবেন শাম্ভালার ২৫ তম শাসক। ঔপন্যাসিক জেমস হিলটন শাম্ভালার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে লিখে ফেলেছিলেন ‘Lost Horizon, about the lost kingdom of Shangri-La’ নামের উপন্যাসটি। হিমালয়ের রহস্যময় নগররাষ্ট্র শাম্ভালা, তার উপন্যাসে হয়ে গিয়েছিল শাংগ্রিলা, যাতে তিব্বতীদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না লাগে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই জ্ঞানগঞ্জের খোঁজ করে চলেছিলেন হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের সিদ্ধপুরুষরা, যারা জ্ঞানগঞ্জ যাওয়ার আমন্ত্রণ পাননি। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের দরবারের শাস্ত্রজ্ঞদের কাছ থেকে জ্ঞানগঞ্জের কথা জানতে পেরেছিলেন ইউরোপীয় ভূপর্যটকেরাও। তারাও সন্ধান শুরু করেছিলেন। কিন্তু কেউই খুঁজে পাননি জ্ঞানগঞ্জ। কেবল অনুমানের তির নিক্ষেপ করেছিলেন হিমালয়ের বিভিন্ন এলাকায়।

কেউ বলেছিলেন জ্ঞানগঞ্জ লুকিয়ে আছে তিব্বতের কৈলাস পর্বতের কাছে থাকা এক গোপন উপত্যকায়। কেউ বলেছিলেন জ্ঞানগঞ্জ লুকিয়ে কাশ্মীর হিমালয়ে। কেউ বলেছিলেন ভারত ও চিন সীমান্তে অবস্থিত ছাং-চেমনো রেঞ্জের কঙ্গকা গিরিপথের কাছেই লুকিয়ে আছে জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্বালা।

আধুনিক যুগেও বহু অভিযাত্রী ‘ইয়েতি রহস্য’ ভেদ করার মতোই ‘জ্ঞানগঞ্জ’ রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারাও সফল হননি। অথচ বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন পুঁথিতে জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালায় যাওয়ার পথনির্দেশ দেওয়া আছে। কিন্তু সাংকেতিক ভাষার মর্মোদ্ধার করা আজ অবধি সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মাত্র কয়েকজন উচ্চকোটির সাধক সেই সাংকেতিক ভাষার রহস্যভেদ করে অতি গোপনে পৌঁছে যান জ্ঞানগঞ্জ।

১৮৩৩ সালে হাঙ্গেরির গবেষক সিসোমা ডি কোরোস গবেষণা শুরু করেছিলেন জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালাকে নিয়ে। বছরের পর বছর তিব্বতে কাটালেও রহস্য ভেদ করতে পারেননি। এরপর জ্ঞানগঞ্জ রহস্যভেদ করতে ভারতে এসেছিলেন রাশিয়ার বিতর্কিত দার্শনিক ও রহস্যসন্ধানী মাদাম ব্লাভাটস্কি। রহস্যভেদ না করতে পারলেও রহস্যের আগুনে ইন্ধন দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন শাম্ভালা বা জ্ঞানগঞ্জ আসলে লুমেরিয়া ও অ্যাটলান্টিসের মতোই মায়াবী। তাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। কারণ নগরটি নিজে থেকে ধরা দিতে চায় না।

জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালার ওপর গবেষণা করেছিলেন রাশিয়ার প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, প্রত্নতাত্ত্বিক, চিত্রশিল্পী, ধর্মতত্ত্ববিদ নিকোলাই রোয়েরিখ। তার মনে হয়েছিল জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালা লুকিয়ে আছে, মঙ্গোলিয়া ও তিব্বতের মাঝে থাকা আলতাই পর্বতশ্রেণির মধ্যে। ১৯২০ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ অভিযান চালিয়েছিলেন সেই এলাকায়। কিন্তু তিনিও খুঁজে পাননি জ্ঞানগঞ্জ। তবে অভিযান চলার সময় একটি অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন। আলতাই পর্বতশ্রেণির দুর্গম উপত্যকায় একদিন সকালে রোয়েরিখ দেখেছিলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য।

ডাইরিতে লিখেছিলেন, ‘উজ্জ্বল সূর্যের মতো আলো ছড়াতে ছড়াতে বিশালকায় ডিমের মতো একটা বস্তু আকাশপথে ছুটে গেল উন্মত্ত গতিতে। আমাদের ক্যাম্প পেরিয়ে গেল। গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ-পূর্বে চলে গেল। আমরা দেখলাম কীভাবে সেটা নীল আকাশে হারিয়ে গেল। তবে আমরা দূরবীণ বের করে বস্তুটির ডিম্বাকার আকৃতি ও সূর্যের মতোই উজ্জ্বল দেহটি দেখার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিলাম।’

পরবর্তীকালে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কী দেখেছিলেন নিকোলাই রোয়েরিখ! তখনও ভিনগ্রহের জীবদের মহাকাশ যান বা ইউএফও নিয়ে আলোচনাই শুরু হয়নি পৃথিবীতে। তাহলে বিশালকায় ডিমের মতো বস্তুটি কী! পুঁথি থেকে জানা গেছে জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালা রূপ পরিবর্তন করে। তাহলে কী স্থানও পরিবর্তন করে জ্ঞানগঞ্জ! তাই তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না!

 

বারবার রূপ বদলানোর ফলে জ্ঞানগঞ্জের হদিশ নাকি দিতে পারছে না বিজ্ঞানও।

বারবার রূপ বদলানোর ফলে জ্ঞানগঞ্জের হদিশ নাকি দিতে পারছে না বিজ্ঞানও।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ওয়েস্টার্ন কমান্ডের অফিসার ছিলেন এল পি ফারেল। ব্রিটিশ হলেও ভারতের দর্শন ও সংস্কৃতি নিয়ে তার ছিল ভীষণ আগ্রহ। সেই ফারেল সাহেব বলেছিলেন, ১৯৪২ সালে তিনি জ্ঞানগঞ্জে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি।

তার ডায়রিতে ফারেল সাহেব লিখেছিলেন, ‘আমাকে যে পথ ধরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সেই পথ ছিল ভীষণ কঠিন, সংকীর্ণ ও বিপজ্জনক। সেই পথে থাকা খাড়া পাহাড় আরোহণ করা আমার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু তবুও আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার অনবরত মনে হচ্ছিল, কেউ আমায় রাস্তা দেখাতে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। আমার শরীরে শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমের পর খাড়া পাহাড়টায় আরোহণ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু শ্বাসকষ্টের জন্য আমার পক্ষে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আমি তাই সামান্য বিশ্রাম নেওয়ার জন্য শুয়ে পড়েছিলাম একটি বর্গক্ষেত্রাকার পাথরের ওপর।

দুমিনিট হয়েছে কি হয়নি, আমার তন্দ্রা কেটে গিয়েছিল একটি গম্ভীর গলার আওয়াজ পেয়ে। পরিষ্কার শুনতে পেলাম, ‘মাননীয় ফারেল, তুমি জুতো খোলো এবং ধীরে ধীরে পাথর থেকে নেমে আমার সঙ্গে এসো।’ আমি তাকিয়ে দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অত্যন্ত শীর্ণকায় এক সাধু। কপাল থেকে যেন জ্যোতি ঠিকরে বের হচ্ছে। জীবনে তাকে দেখিনি। পরিচয় তো দূরের কথা। কিন্তু তিনি আমার নাম জানলেন কীভাবে? কীভাবে জানলেন আমি এখানে এসেছি!

সাধুটি আমাকে বলেছিলেন তুমি যা শুনেছ ও যা দেখেছ, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এটা বুঝতে গেলে সমস্ত জাগতিক সুখ ভুলে, ইন্দ্রিয়ের আনন্দ ভুলে, বহু বছরের নিগুঢ় সাধনার প্রয়োজন।’ এরপর সাধুবাবা দূর থেকে ফারেলকে দেখিয়েছিলেন বরফের পাহাড়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা সেই স্বপ্নপুরীটিকে। ফারেল দেখেছিলেন, বরফের সমুদ্রের মাঝে অবর্ণনীয় সৌন্দর্য নিয়ে জেগে উঠেছে ‘জ্ঞানগঞ্জ’। নগরীটির রঙ ক্ষণে ক্ষণে পালটে যাচ্ছে। নগরীটিকে ঘিরে আছে নীল রঙা কুয়াশা। আর এগোবার অনুমতি পাননি ফারেল সাহেব। ফিরে আসতে হয়েছিল জ্ঞানগঞ্জের দরজা থেকে।

জ্ঞানগঞ্জ বা সিদ্ধাশ্রমের কথা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন প্রখ্যাত দার্শনিক, ভারত-তত্ত্ববিদ ও সংস্কৃত বিশারদ পন্ডিত গোপীনাথ কবিরাজ। জ্ঞানগঞ্জের কথা বলেছিলেন স্বামী বিশুদ্ধানন্দ পরমহংস। তিনি বলেছিলেন, তাকে ছোটবেলায় জ্ঞানগঞ্জে নিয়ে গিয়েছিলেন কোনো সিদ্ধপুরুষ। সেখানে তিনি বহু বছর সাধনা করেছিলেন। জ্ঞানগঞ্জের কথা বলে গিয়েছেন স্বামী নাদানন্দ অবধূত ও ডঃ নারায়ণ দত্ত শ্রীমালি।

 

হিমালয়।

হিমালয়।

মহারাষ্ট্রের ধর্মগুরু ‘সাঁই কাকা’। তিনিও নাকি বহুবার গিয়েছেন জ্ঞানগঞ্জে। এক ঋষি তাকে নিয়ে যেতেন জ্ঞানগঞ্জে। সেখানে প্রত্যেকবার পৌঁছনোর পর দেখতেন, সম্পুর্ণ নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে জ্ঞানগঞ্জ।

যার কথা তিব্বতের বেশিরভাগ মানুষ মানেন, সেই চতুর্দশ দলাই লামা লামো থোন্ডুপ কিন্তু মানেন না জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালা তত্ত্ব। তিনি বলেছেন এটা নিছকই কিছু মানুষের অনুমান। আসলে জ্ঞানগঞ্জ বা শাম্ভালার অবস্থান মানুষের মনে। যারা সত্যের পথে জীবন চালান, তাদের কর্মফলই পৌঁছে দেয় জ্ঞানগঞ্জে। প্রশ্ন হলো, তাহলে কি হাজার হাজার বছর ধরে পুরানো ধর্মীয় পুঁথিগুলো আমাদের ভ্রান্ত পথে চালিত করেছে!  নাকি আমরাই আগাগোড়াই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছি শাস্ত্রের ইঙ্গিত।

তাহলে কি জ্ঞানগঞ্জ বলে আদৌ কোনো নগররাষ্ট্র নেই! তাহলে কি জ্ঞানগঞ্জ, ১৫১৬ সালে লিখে যাওয়া টমাস মুরের উপন্যাস ইউটোপিয়ার মতোই একটি কল্পরাজ্য! নাকি প্লেটোর বলে যাওয়া ‘অ্যাটলান্টিস‘-এর মতোই কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া এক রাষ্ট্র। যাকে খুঁজে পাওয়ার মতো প্রযুক্তি আজও আমাদের হাতে নেই। কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর! যেহেতু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি, তাই জ্ঞানগঞ্জ নিয়ে বিতর্ক এবং জ্ঞানগঞ্জ খুঁজে পাওয়ার জন্য অভিযান আজও একই সঙ্গে চলছে। যা বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

গাজীপুর কথা

আরো পড়ুন