ঢাকা,  শুক্রবার  ২৯ মার্চ ২০২৪

Gazipur Kotha | গাজীপুর কথা

সীমার মাঝে অসীম তুমি

প্রকাশিত: ১৬:০৯, ৩ আগস্ট ২০২০

সীমার মাঝে অসীম তুমি

১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টেলিভিশনে ‘ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি আলোচনা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। সদ্যস্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট প্রশ্ন করেছিলেন, শেখ মুজিবের সবচেয়ে বড় গুণ কোনটি? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন- দেশের মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা। এরপর ডেভিড ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কোনটি? চোখ মুছতে মুছতে জাতির পিতা বলেন, তাদের প্রতি আমার প্রগাঢ় ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর সাফল্য ও ব্যর্থতা, শক্তি ও দুর্বলতার সকল উৎসই ছিল জনগণ।

ওই প্রোগ্রামে ডেভিড ফ্রস্ট আরো জানতে চেয়েছিলেন, পৃথিবীর মানুষের জন্য কী বহন করে নিয়ে যেতে পারেন। বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ‘আমার একমাত্র প্রার্থনা, বিশ্ব আমার দেশের মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসুক। আমার হতভাগ্য মানুষের পাশে এসে বিশ্বের মানুষ দাঁড়াক। আমার দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দুঃখ ভোগ করেছেন, এমন আত্মত্যাগ পৃথিবীর খুব কম দেশের মানুষকেই করতে হয়েছে। আমার এ বাণী বহন করুন, সবার জন্য আমার শুভেচ্ছা। আমি বিশ্বাস করি আমার দেশের কোটি কোটি মানুষের পাশে বিশ্ব দাঁড়াবে।’

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ দেশের প্রতিটি আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রিত্বের চেয়েও সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সব সময় সোচ্চার থেকেছেন। বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু স্বপ্ন ছিল- সোনার বাংলা গড়া। তিনি ভালোবেসেছিলেন বাংলাদেশকে, ভালোবেসেছিলেন বাংলাদেশের মানুষকে। আর তাই তো নির্ভয়ে বলতে পেরেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময়ও আমি বলব- আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার আগে তার সহকর্মীরা পালানোর জন্য শত অনুরোধ করলেও বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে আমি যাব না। মরতে হলে আমি এখানেই মরব। বাংলা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়।’

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সভায় উপস্থিত লক্ষাধিক জনতা যেন এই ঘোষণা শুনতেই এসেছিলেন। তাদের প্রিয় মুজিব ভাই আজ ‘বঙ্গবন্ধু’। তিনি জানতেন মানুষের ভালোবাসাই তার বড় শক্তি। সেই শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বঙ্গবন্ধু জনসভায় বলেছিলেন, ‘সংগ্রাম করিয়া আমি আবার কারাগারে যাইবো। কিন্তু মানুষের প্রেম ভালোবাসার ঢালি মাথায় নিয়া দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিতে পারিব না।’

রাজনীতির মনীষী। ছবি: সংগ্রহ।

বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয়দফার আলোকে সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে উপহার দিয়েছিলেন এক অবিস্মরণীয় বিজয়। মহান একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো বাংলা। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চেই মূলত, ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন লাখো জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মত দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন বাংলার স্বাধীনতা, ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপাদমস্তক একজন খাঁটি বাঙালি। সহজ সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে তিনি নিজকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাঙালিয়ানার প্রবাদপুরুষ হিসেবে। কথাবার্তা, চলনে-বলনে, পোশাকে তিনি ছিলেন একজন স্বার্থক বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে ছিল অগাধ দেশপ্রেম, নিজের ভাষা-সংস্কৃতি ও মানুষের প্রতি প্রবল ভালোবাসা তিনি সব সময় সাদামাটা পোশাক পরিধান করতেন। বাইরের পায়জামা ও পাঞ্জাবি পরলেও ঘরে তিনি তাঁতের লুঙ্গি ও হাতকাটা গেঞ্জি পরিধান করতেন। পছন্দ করতেন বাঙালির চিরায়ত খাদ্য ভাত ও মাছ। সকালের নাশতায় রুটির পরিবর্তে পান্তাভাত খেতেই বেশি পছন্দ করতেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন কয়েকটি কারণে- সেগুলো হলো : লক্ষ্যবিচ্যুত না হওয়া, লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য একাগ্রতা, সাহস, সহৃদয়তা, মানবিকতা, আত্মত্যাগ, সত্যনিষ্ঠা এবং সহিষ্ণুতা। তার চলাফেরা, পোশাকআশাক, কথাবার্তা, চালচলন সবকিছুর মধ্যেই ছিল বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বন্ধন অটুট রাখার ইচ্ছা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের সেই মহামানব, সময় যাকে সৃষ্টি করেনি, যিনি সময়কেই নিজের করতলে নিয়ে এসেছেন। যিনি কঠিন স্বরে নিজস্ব ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পঙক্তি ‘আমাদের আর দাবায়ে রাখবার পারবা না।’ বঙ্গবন্ধু জাতির সামনে এই অমর বাক্যটি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাঙালির জীবনে এই ঘটনা আর কোনোদিন পুনরাবৃত্তি হবে না।

গাজীপুর কথা